আকাশের গায়ে জাতীয়তাবাদ, এখনও অধরা চাঁদ
১৫ জুলাই ২০১৯সোমবার সকালে কথা ছিল ‘চন্দ্রযান-২' আকাশে উড়বে৷ দু’মাস পরে চাঁদের পিঠে নামার কথা ছিল তার৷ কিন্তু লঞ্চ হবার একঘন্টা আগে ইসরো, অর্থাৎ ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের পক্ষে একটি টুইটে জানানো হয় যে উড়ান স্থগিত রাখা হয়েছে৷ আবার কবে আকাশে উড়তে পারে ‘চন্দ্রযান-২', সে বিষয়ে এখনই কোনো নির্দিষ্ট তারিখ জানাননি তারা৷
ভারতের ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের সাবেক প্রধান রবি গুপ্তা যদিও এই ঘটনাকে দেখছেন ভালো পদক্ষেপ হিসাবে৷ তাঁর মতে, এই উৎক্ষেপন সোমবারে সম্পন্ন হলে বিশাল কোনো বিপদের সম্ভাবনা থেকে যেতে পারত৷ ‘চন্দ্রযান-২' অভিযান ব্যর্থ হবার পর থেকে উঠছে নানামুখী প্রশ্ন৷
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে না কেন বর্তমান ভারতের মহাকাশ গবেষণায় কমছে লগ্নি, সংখ্যার তুলনায় প্রকৌশলীদের কাজ নিকৃষ্ট মানের৷ এমন তথ্য জানাচ্ছে ২০১৪ সালে পেশ হওয়া ম্যাককিনসি সংস্থার একটি প্রতিবেদন৷
তবুও কেন পিছিয়ে ভারতের মহাকাশ গবেষণা? রাষ্ট্রের মহাকাশে আগ্রহ কি তবে শুধুই মার্কিন-চীন একাধিপত্যকে ঠেকাতে নির্ধারিত হচ্ছে?
ভারতের মহাকাশ-পরিকল্পনা ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসলে মহাকাশ বিষয়ক পোর্টফোলিও নিজের দায়িত্বেই রাখেন৷ সম্প্রতি পেশ হওয়া ২০১৯-২০২০ সালের বাজেটে মহাকাশ বিভাগের জন্য বরাদ্দ অর্থ বেড়ে দাঁড়ায় ১২,৪৭৩ কোটি ভারতীয় রুপিতে৷
এই পদক্ষেপকে অনেকে দেখছেন আকাশে ভারতের বাড়ন্ত ক্ষমতায়নের সূত্র হিসাবে৷
শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালে ইসরো একই মিশনে মহাকাশে ১০৪টি স্যাটেলাইট পাঠিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করলে তা নিয়ে টুইটার-ফেসবুকে শুরু হয় হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মাতামাতি৷
ইসরোর বিজ্ঞানীদের সাফল্যকে এক্টিভিস্ট মধু কিশওয়ার দেখেন হিন্দু বিজ্ঞানীদের সাফল্য হিসাবে৷ তুলনা টেনে তিনি বলেন, ‘‘এমন সমান সাফল্য কোনো নাস্তিক বিজ্ঞানীর নেই৷'' বিজ্ঞানের নামে ‘হিন্দু বিদ্বেষ'-এর আঁচ পান তিনি এই পরিপ্রেক্ষিতে৷
একই যুক্তির সূত্র ধরে শুরু হয় ভাইরাল ‘মিম’-এর ছড়াছড়ি৷ কিন্তু কারো নজরে পড়েনা যে ইসরো আসলে বর্তমানে একটি লাভজনক সংস্থায় পরিণত হয়েছে, যার ফলে ভারতের চেয়ে অনেকাংশেই বেশি লাভবান হচ্ছে অন্যান্য দেশ৷ শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়েই এখন পর্যন্ত ইসরো পাঠিয়েছে মোট ১৪৩টি স্যাটেলাইট৷ সেই তালিকায় রয়েছে জার্মানি, আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্যসহ ২৫টিরও বেশি দেশ৷ পাশাপাশি, ভারতের মাটিতে তৈরি হওয়া একাধিক রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিদেশি রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া হয় নিয়মিতভাবে৷
তার সাথে, ২০১৭ সালে স্পেস এক্টিভিটিস অ্যাক্টের মাধ্যমে স্যাটেলাইট বানানো থেকে তা পরিচালনার কাজে আইনগতভাবে ১০০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে সরকার৷ ফলে, ক্রমশই বিদেশি রাষ্ট্রের হাতে ইসরোর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে সরকার, এমন প্রশ্ন তোলা বোধহয় খুব একটা অযৌক্তিক নয়৷
কিন্তু তারপরেও ইসরোর কার্যকলাপে জাতীয়তাবাদ খুঁজে পান অনেকে৷ দেখতে পান না সেখানে নয়া-উদার অর্থনীতির বাড়ন্ত হস্তক্ষেপ, যার ফলে ভারতে মহাকাশ চর্চায় লগ্নি ঠিকই হচ্ছে, কিন্তু আশানুরূপ ফলাফল হচ্ছে না৷ সাফল্যের আশায় ইসরোর প্রধান বিজ্ঞানী মন্দিরে খুঁজছেন ইশ্বরের আশীর্বাদ৷ বিজ্ঞানের ওপর ভরসা বর্তমান ভারতে বিজ্ঞানীদেরই নেই৷ তাহলে কোন পথে চলছে দেশের বিজ্ঞানমনস্কতা?
আর ভারতে মহাকাশ প্রকৌশলীবিদ্যার মান? সে আরেক নতুন বিতর্কের বিষয়৷ আপাতত আলোচনা তোলা থাক কেন ইসরো এখন হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতীক৷ আর কেনই বা ভারতের সংবাদমাধ্যমে কেবল উঠে আসে ভারতের সাফল্যের কথা, বাদ পড়ে যায় একটি বিক্রি হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থার সত্য৷
শবনম সুরিতা