1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আদালত এলাকায় আসামিদের হেনস্থা নিয়ে প্রশ্ন

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৪ আগস্ট ২০২৪

বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও নেতাদের পাশাপাশি গ্রেপ্তার হয়েছেন দুইজন সাংবাদিক৷ আদালতে হাজিরের সময় তাদের নিরাপত্তা ও যথাযথ আইনি অধিকার পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে৷

https://p.dw.com/p/4jsL4
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আদালত চত্বরে হেনস্থার শিকার হন৷ ছবি: Stringer/REUTERS

আটক হওয়া নেতাদের অনেকে আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই শারীরিক হামলার শিকার হয়েছেন৷ 

এদিকে আটক হওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পক্ষে কোনো আইনজীবী আদালতে দাঁড়াচ্ছেন না বলে জানা গেছে৷ দুই-একজন চেষ্টা করলেও তারা শেষ পর্যন্ত বক্তব্য রাখতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে৷ এসব ঘটনা মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছেন অধিকারকর্মীরা৷         

আইনজীবীরা কেন গ্রেপ্তার হওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পক্ষে আদালতে দাঁড়াচ্ছেন না সেই বিষয়ে জানতে অন্তত দুইজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছেন, আদালত এলাকায় আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা ভয়ে আসছেন না৷  কেউ সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপিদের পক্ষে দাঁড়ালে তাদের ‘দালাল ট্যাগ’ দেয়া হবে এই ভয়ে নির্দলীয় আইনজীবীরাও এই সময়ে ঝুঁকি নিতে চাইছেন না৷

হেনস্থা, হামলার শিকার গ্রেপ্তারকৃতরা

বাংলাদেশের সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার দনা সীমান্ত এলাকা থেকে শুক্রবার রাতে আটক হন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক৷ শনিবার স্থানীয় সময় বিকালে সিলেটের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাকে তোলা হয়৷

টেলিভিশন চ্যানেল সময় টিভির এক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশের গাড়ি থেকে নামার পরই সাবেক এই বিচারপতির ওপর হামলে পড়েন অনেকে৷ পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই তার মাথায় আঘাত করা এবং তার দিকে জুতা ছুড়ে মারছেন অনেকে৷ একপর্যায়ে দেখা গেছে, নিরপত্তার জন্য পুলিশের দেয়া হেলমেটটি খুলে ফেলা হয়েছে৷ এই অবস্থায় প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কির মধ্যে টেনে হিঁচড়ে তাকে আদালত ভবনে প্রবেশ করানো হয়৷

বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ৭১ টিভির সাংবাদিক দম্পতি শাকিল আহমেদ ও ফারাজানা রূপাকে  ২১ আগস্ট ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়৷ পরে উত্তরা পূর্ব থানার একটি হত্যা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷ ২২ আগস্ট তাদেরকে আদালতে হাজির করার সময় ফারজানা রূপাকে পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যেই ঘুসি মারা হয়৷ তার স্বামী শাকিল আহমেদ সেসময় চিৎকার করে এই ঘটনার বিচার চান৷ 

'আসামিকে হেনস্থা করাও মানবাধিকার লঙ্ঘন'

তার আগে সাবেক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যগ্ম সম্পাদক ডা. দীপু মনিকে মোহাম্মদপুর থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়৷ আদালত এলাকায় তার ওপর চড়াও হন একদল আইনজীবী৷ তার ওপর ডিম নিক্ষেপ ছাড়াও, শারীরিকভাবে হেনস্থা করা হয়৷ ওই সময় আইনজীবী ও পুলিশ ছাড়া বাইরের তেমন কোনো লোককে দেখা যায়নি৷

সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান আদালতে হাজির করা হলে আদালত চত্বরে তারা হেনস্থার শিকার হন৷ তাদের দিকে জুতাও নিক্ষেপ করা হয়৷

এইসব ঘটনায় আসামিদের ঘিরে বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিত দেখা গেলেও আক্রমণ থেকে তারা রক্ষা পাননি৷ আর এক্ষেত্রে অভিযোগের তীরটি আইনজীবীদের দিকে৷ 
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন আইনজীবী বলেন, ‘‘বিগত সরকারের মন্ত্রী এমপিদের আদালতে হাজির করার খবর পেলেই একদল আইনজীবী আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন৷ হাজতখানা থেকে যখন আদালতে হাজির করা হয় তখন তারা আসামিদের ঘিরে ধরে নানা স্লোগান ও কটূক্তি করেন৷ হেনস্থা করেন৷’’

তিনি বলেন, ‘‘তখন বিপুল সংখ্যক পুলিশ এবং আসামিদের হেলমেট ও ভেস্ট পরানো থাকলেও তারা রক্ষা পান না৷ তাদের ওপর ইটের টুকরা, জুতা, ডিম নিক্ষেপ ছাড়াও তাদের সরাসরি কিল ঘুসি দেয়া হয়৷ শুধু দুইজন সাবেক সামরিক অফিসার ছাড়া সবাই কোনো না কোনোভাবে শারীরিক হেনস্থার শিকার হয়েছেন৷ একমাত্র সাবেক সামরিক অফিসার জিয়াউল আহসানের পক্ষে তার বোন আইনজীবী হিসেবে আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন৷ তবে তিনিও দ্রুত আদালত ত্যাগ করেন৷’’

আদালত চত্বরে ফারজানা রূপা এবং তার স্বামী শাকিল আহমেদ
ফারজানা রূপাকে পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যেই ঘুসি মারা হয়৷ তার স্বামী শাকিল আহমেদ সেসময় চিৎকার করে এই ঘটনার বিচার চানছবি: AFP

অন্যদিকে ডা. দীপু মনিকে যেদিন আদালতে হাজির করা হয় সেদিন আসামিদের বিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে সংবাদমাধ্যমে কে আগে বক্তব্য দেবেন তা নিয়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে৷

অন্যদিকে ২২ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবী ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলামকে আইনজীবী ভবনে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্টেও আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা ভয়ের কারণে আসতে পারছেন না বলে দাবি করছেন অনেকে৷ 

যা বলছেন বিশ্লেষকেরা

মানবাধিকারকর্মী এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘‘যাদেরকে আদালতে আনা হয়েছে তাদের কিল, ঘুসি মারাসহ নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে৷ আর এটা খুবই দুঃখজনক যে কোনো কোনো আইনজীবী ওইসব ঘটনায় যুক্ত হয়ে পড়েছেন৷ নারীদের ওপরও হামলা হয়েছে৷ এটা দুঃখজনক এবং এর নিন্দা জানাই৷’’
এই আইনজীবীর মতে, এখানে পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থায় যারা আছেন তাদের আদালত এলাকায় নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে৷ নিরাপদ করতে হবে৷ এইসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশা করেন তিনি৷ 
তিনি আরো বলেন, ‘‘আবার অভিযুক্তদেরকে তাদের আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে দেয়া হচ্ছে না৷ এতে তো বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়৷’’
এদিকে আসামিদের উপর হামলা, তাদেরকে হেনস্থা করার ঘটনাকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো আলী রীয়াজ৷ অভিযুক্ত ব্যক্তির নিরাপত্তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি৷  
শুক্রবার ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে ড. রীয়াজ লিখেছেন, ‘‘আদালত প্রাঙ্গণে এবং আদালতে সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে আমি উদ্বেগজনক বলে মনে করি৷ যেকোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির ন্যায়বিচার প্রাপ্তি যেমন অধিকার তেমনি তার নিরাপত্তা বিধান সরকারের দায়িত্ব৷ আটক ব্যক্তিদের আদালতে হাজির করার সময় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার যাতে করে এই ধারণা তৈরি না হয় যে, তিনি ন্যায়বিচার বঞ্চিত হতে পারেন৷’’
মানবাধিকারকর্মী নূর খানের মতে, আসামির উপর হামলা মানবাধিকারের লঙ্ঘন৷ হামলার ঘটনায় আইনজীবীদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিকে দুঃখজনক বলেও মন্তব্য করেন এই মানবাধিকারকর্মী৷    
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘‘আদালত এলাকায় কোনো কোনো আসামিকে চরম হেনস্তা করার অভিযোগ আমরা পাচ্ছি৷ সবচেয়ে দুঃখজনক

'হেনস্থায় আইনজীবীদের যুক্ত হয়ে পড়া দুঃখজনক'

হলো, আইনজীবীরাও চড়াও হচ্ছেন৷ এটি একটি সভ্য সমাজে কাম্য নয়৷ এটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘এতে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হবে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার, আইনজীবী নিয়োগের অধিকার সব আসামিরই আছে৷’’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক হামলার ঘটনাকে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ‘মানুষের ক্ষোভ এবং ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ’ হিসেবে দেখছেন৷ তবে সেইসাথে আসামিদের নিরাপত্তা প্রদানের দাবি জানান তিনি৷ 

সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, ‘‘তাদের বিরুদ্ধে মানুষের যে ক্ষোভ ও ঘৃণা তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আদালত এলাকায় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে৷ আর ঘৃণার কারণেই অনেক আসামি আইনজীবী পাচ্ছেন না৷ তাদের পক্ষে আইনজীবীরা দাঁড়াচ্ছেন না৷ তবে তাদের নিরাপত্তাহীনতা ও ঘৃণা প্রশমনের ব্যবস্থা করতে হবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের জন্য আইনজীবী নিয়োগ করা৷ তারা যাতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন তার ব্যবস্থা করা৷ সেটা না করা হলে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হবে৷’’

আসামিদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (আদালত) আনিসুর রহমান বলেন, ‘‘আমরা আসামিদের নিরাপত্তায় প্রচুর পুলিশ ফোর্স রাখছি৷ আসামিদের হেলমেট ও ভেস্ট পরানো হচ্ছে৷ তারপরও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে৷ সব পক্ষকে সহনশীল হতে হবে৷ তা না হলে এগুলো রোধ করা সম্ভব নয়৷’’

তবে তিনি দাবি করেছেন, ‘‘ডিম নিক্ষেপ ছাড়া তেমন কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি৷’’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এসব ঘটনার ব্যাপারে কোনো মামলা হয়নি বা কেউ অভিযোগও করেননি৷’’