আদিবাসীদের ভাষা কি আধিপত্যের শিকার?
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩তার মনে করেন, একই প্রক্রিয়ায় বাংলা নিজেও এখানে ইরেজি আধিপত্যের শিকার৷
বাংলাদেশে কমবেশি ৫১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আছে৷ তাদের ভাষা আছে ৪৫টি৷ তার মধ্যে ১৪টি ভাষা বিলুপ্তির পথে বলে চিহ্নিত করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট৷৷ এর মধ্যে মহাবিপন্ন হলো রেমিংটচা৷ এই ভাষায় মাত্র ছয় জন লোক এখন কথা বলেন৷ আদিবাসীদের ভাষার গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা জানান,"এই ভাষায় যে ছয়জন কথা বলেন তাদের সর্ব কনিষ্ঠজনের বয়স ৫৬ বছর৷ এই ছয়জন মারা গেলে ভাষাটি হারিয়ে যাবে৷ এর কোনো লিখিত রূপ নাই৷ আবার যে ছয়জন আদিবাসী এই ভাষায় কথা বলেন তারা একই পরিবার বা একই এলাকায় থাকেন না৷”
শুধুমাত্র রেমিংটচা ভাষা নয়৷ এর সঙ্গে মহা বিপদাপন্ন যে আরো ১৩টি ভাষা আছে সেইসব ভাষায় কথা বলা আদিবাসীর সংখ্যাও কমছে৷ এই ১৪টি ভাষায় কেনোটিতে সর্বোচ্চ দুই হাজার আদিবসী কথা বলেন৷ কিন্তু কোনোটিরই বর্ণমালা বা লিখিত রূপ নাই৷
মাত্র পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় টেক্সটবুক আছে৷ তাও আবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত৷ সরকারি উদ্যোগে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদ্রি এই পাঁচটি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক করা হয়েছে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত৷ মথুরা ত্রিপুরা বলেন,"ফলে এটা আসলে পরবর্তী শিক্ষায় আর কাজে লাগে না৷আমাকে তাই বাংলা ইরেজিসহ ছয়টি ভাষা শিখতে হয়েছে৷”
বাংলাদেশে এখন সর্বোচ্চ ২০টি আদিবাসী ভাষার বর্ণমালা ও লিখিত রূপ আছে৷ বাকিগুলো ওইসব জনগোষ্ঠীর মুখে আছে৷ ফলে সেগুলোও বর্ণমালা ছাড়া টিকবে না, হারিয়ে যাবে৷
মথুরা ত্রিপুরা বলেন, "এখানে সরকারের দায়িত্ব আছে৷ কিছু কাজ সরকারের উদ্যোগে হলেও তা সামান্যই৷ কিন্তু যাদের ভাষা তাদেরও দায়িত্ব আছে৷ ভাষার চর্চা, ওই ভাষায় লেখালেখি বা সাহিত্য চর্চা না করলে তো ভাষা টিকবে না৷”
তার মতে, "যে ভাষায় যত কম লোক কথা বলেন সেই ভাষা তত বিপন্ন৷ সার্বিকভাবে এই ভাষাগুলো বাংলার আধিপত্যের শিকার৷ আবার ওই আদিবাসীদের মধ্যে যাদের ভাষায় বেশি লোক কথা বলেন তাদের আধিপত্যের শিকার অন্য ক্ষুদ্র ভাষা গোষ্ঠী৷ এর অর্থনৈতিক দিকও আছে৷ চাকরি পেতে ব্যবসা করতে যে ভাষার গুরুত্ব বেশি সেই ভাষা অন্য ভাষাকে দুর্বল করে দেয়৷”
বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য এবং আদিবাসী কবি ও গবেষক সিং ইয়ং ম্রো বলেন,"কিছু ভাষা আছে যেগুলো আসলে টিকিয়ে রাখার আর কোনো সুযোগ নাই৷ ওই ভাষার বর্ণমালাও নাই আবার লোকও খুবই কম৷ ফলে তারা হারিয়ে যওয়া সময়ের ব্যাপার৷ কিছু ভাষা আছে যে ভাষায় কথা বলার লোক মোটামুটি আছে৷ কিন্তু এর বর্ণমালা তৈরি করতে গিয়ে সংকট হচ্ছে৷ কারণ তারা একমত হতে পরছেন না৷ যেমন খুমি ভাষা৷ এধরনের ভাষাও হারিয়ে যাবে৷”
তার কথা,"চর্চা রাখতে হবে৷ ওই ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ না থাকলেও সাহিত্য, গল্প, কবিতাসহ আরও চর্চার ক্ষেত্র আছে৷ সেটা করতে হবে৷ তা না হলে ভাষা টিকবে না৷ যেমন আমরা ম্রো ভাষায় সাহিত্য চর্চা করছি৷ নিজেরাই পড়ালেখার বই ছাপিয়েছি৷ কম্পিউটারে ফন্ট তৈরি করেছি৷ আমাদের তরুণ প্রজন্ম এখন নিজের ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে৷ তবে সরকারের উদ্যোগও আরো প্রয়োজন৷ যেমন আমরা বান্দরবান জেলা পরিষদের নিয়ম করেছি এখানে কোনো চাকরির আবেদন করলে নিজের মাতৃভাষার জন্য ১০ নাম্বার রেখেছি,” জানান সিং ইয়ং ম্রো৷
তিনি বলেন," বাংলা, ইরেজি না জানলে চাকরি পাওয়া যায়না৷ ফলে আদিবাসী ভাষার গুরুত্ব অনেক কম৷ সেই বিবেচনায় বাংলাও এখন ইরেজির কাছে অবহেলার শিকার৷”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুমন সজ্জাদ আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন অনেক দিন ধরে৷ তিনি বলেন, "আমার কাছে মনে হয়েছে আদিবাসীদের ভাষা বাংলা ভাষার আধিপত্যের শিকার হয়েছে৷ আর তাদের ভাষার চর্চা কমেছে এবং বর্ণমালা সময়ের সঙ্গে আপডেট করার যে বিষয় রয়েছে তা তারা করেনি৷ ভাষার ধাপগুলো যেভাবে পেরোতে হয় তারা তা করছে না৷ ফলে অনেক ভাষাই এখন বিপদাপন্ন এবং হারিয়ে যাওয়ার পথে৷”
তার কথা,"বাংলা একাডেমি তো শুধু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য কাজ করে৷ এখানেও আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্যের কোনো জায়গা নেই৷”
তিনি বলেন, মহান ভাষা আন্দোলনের স্মরণে ভাষার মর্যাদা নিয়ে কাজ করলে আদিবাসীদের ভাষা অবহেলিত থাকার কথা নয়৷
তিনি মনে করেন,"প্রত্যেক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে আদের ভাষার চর্চা রাখা যেমন জরুরি৷ তেমনি সরকারকেও উদ্যোগী হতে হবে৷”
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক রুনেল চাকমা বলেন,"আমরা তিনটি নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সাংস্কৃতি নিয়ে কাজ করি৷ চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা৷ এর বাইরে আমাদের কোনো কাজ নেই৷”
আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ বলেন,"আমরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণসহ এর চর্চা ও বিকাশে একটি প্রকল্প নিয়েছি৷ এখন জনবল ও অবকাঠামোর কাজ চলছে৷ ওই ভাষাগুলোর সংকট নিয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে৷আমরা অবশ্যই কাজ করব৷”