সংবাদমাধ্যমে ভাষার মর্যাদা রক্ষার হাল
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩সংশ্লিষ্টদের অনেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করছেন না৷ তবে ভুল বানান ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে কারো কারো মাঝে৷
অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে বানান ঠিক রাখার জোর প্রয়াস তেমন একটা দেখা যায় না৷ প্রুফ রিডার বা সম্পাদনা সহকারী নেই৷ এমনকি ‘বড়' পত্রিকার অনলাইন সংস্করণেও কোনো সম্পাদনা সহকারী রাখা হয় না৷
দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকার প্রধান সম্পাদনা সহকারী জহিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রুফ রিডিং বিভাগ একটি পত্রিকার বানান ও বাক্য গঠন দেখার জন্য সর্বশেষ চেকপোস্ট হলেও এখানে গুরুত্ব দিন দিন কমছে৷ আর অনলাইনে তো সম্পাদনা বিভাগই নেই৷”
তার কথা, ‘‘এই পেশায় তরুণদের আগ্রহও দিন দিন কমছে৷ কারণ, এই বিভাগে যারা কাজ করেন, তারা সবচেয়ে অবহেলিত৷ তাদের বেতন-ভাতাও কম৷”
তবে তিনি বলেন, ‘‘বানান নিয়ে সংবাদমাধ্যমে সংকটের প্রধানত দুইটি কারণ৷ প্রথমত, অধিকাংশ পত্রিকারই নিজস্ব বানানরীতি নেই৷ ফলে একই পত্রিকায় একই শব্দের বানান ভিন্ন ভিন্নভাবে ছাপা হয়৷ আর আমাদের জাতীয়ভাবে একক কোনো বানানরীতি নেই৷ বাংলা একাডেমির অভিধানে একই শব্দের চার ধরনের বানানও রয়েছে৷ ফলে পরিস্থিতি যা হবার তা-ই হয়েছে৷”
বাংলাদেশে অনলাইন সংবাদমাধ্যম অনেক বিস্তার লাভ করেছে৷ সংখ্যায় বাড়ছে৷ কিন্তু বাংলা বানান নিয়ে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের অবস্থা শোচনীয়৷ শুধু ভুল বানান নয়, অনেক শব্দের অক্ষরই বাদ পড়ে যায়৷ এর প্রধান কারণ প্রুফ রিডার না থাকা৷ কপি এডিটরদেরই এই কাজটি করতে হয়৷
বাংলা অনলাইন নিউজপোর্টাল ঢাকা পোস্টের সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার বলেন, ‘‘আসলে অনলাইনগুলোতে প্রুফ রিডারের প্রচলন হয়নি৷ আমাদের এখানে এভাবেই শুরু হয়েছে এবং চলছে৷ ডিজিটাল সাংবাদিকতার এই যুগে এখন একজনকেই অনেক কাজ করতে হয়৷ তাই রিপোর্টারকেও শুদ্ধভাবে লিখতে জানতে হয়৷ কিন্তু আমাদের এখানে সেই ধরনের দক্ষ জনশক্তি এখনো তৈরি হয়নি৷ প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা নেই, প্রশিক্ষণ নেয়ার আগ্রহও নেই৷”
‘‘আমাদের বাংলা ভাষার সর্বজন-গ্রহণযোগ্য কোনো বানানরীতিও নেই যে সেটা আমরা অনুসরণ করবো৷ ফলে বানান নিয়ে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা চলছে,” বলে মনে করেন মহিউদ্দিন সরকার৷
আজকাল লেখার সময়ও কেউ কেউ বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন৷ এর কারণ জানাতে গিয়ে মহিউদ্দিন সরকার উল্লেখ করলেন সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজশন (এসইও)-র কথা৷ তিনি বলেন, এ কারণে বাংলার সঙ্গে না চাইলেও মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে হয়৷ এ কারণে অনেক সময় শিরোনামেও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে হয় বলে জানান তিনি৷
এফএম রেডিও এবং টেলিভিশনের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষা নিয়ে এক ধরনের ‘স্বেচ্ছাচারিতা’র অভিযোগ প্রসঙ্গে রেডিও টুডের প্রধান বার্তা সম্পাদক ইমামুল হক শামিম বলেন, ‘‘আমরা বাংলা ও ইংরেজি এক সঙ্গে ব্যবহার করি৷ এখানে এটা প্রচলিত৷ তবে আমরা যে নীতি মানি তা হলো যে ভাষার শব্দই ব্যবহার করি না কেন সেটা সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে হবে৷ কোনো শব্দের অশুদ্ধ উচ্চারণ আমরা অগ্রহণযোগ্য মনে করি৷”
তার কথা, ‘‘বাংলা শব্দকে ইংরেজির মতো করে উচ্চারণেরও প্রবণতা আছে৷ নাটকেও আমরা সেটা দেখেছি৷ এটাও আমরা গ্রহণযোগ্য মনে করি না৷”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সিকদার মনোয়ার মুর্শেদ (সৌরভ শিকদার) মনে করেন, সংবাদ মাধ্যমে বাংলা বানানের ‘দুরবস্থার’ প্রধানত দুইটি কারণ:
১. শুদ্ধ বানান না জানা ও শিক্ষার অভাব এবং
২. রাষ্ট্রীয়ভাবে বানান শুদ্ধ করার ব্যাপারে সেরকম কোনা উদ্যোগ না থাকা৷
তার মতে, ‘‘আমরা মাতৃভাষাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেই না৷ আমাদের মাতৃভাষার প্রেম এই ২১ ফেব্রুয়ারি বা এক-দুই দিনের৷ আমরা আমাদের ভাষাকে অবহেলা করি৷ বাংলা একাডেমির উচিত একটা মানসম্পন্ন বানানরীতি তৈরি করা ৷ সেটা করা হলে সবাই সেই বানানরীতি অনুসরণ করবে৷”
তিনি বলেন, ‘‘বাংলা ভাষায় বানানের সমতা বিধানের জন্য বাংলা একাডেমি একটি কমিটি গঠন করেছে ছয় মাস আগে৷ আমিও সেই কমিটির সদস্য৷ সেই কমিটির একটি মাত্র সভা হয়েছে৷ অনেকগুলো অমীমাংসার সমাধান হওয়া দরকার৷ ঈদ বানান আমরা ই-কার না ঈ-কার দিয়ে লিখবো সেটা নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন৷” তিনি মনে করেন, বানানরীতি ঠিক করে অনলাইনে একটি স্পেল চেকার করলে নৈরাজ্যের অনেকটাই অবসান ঘটবে৷
সৌরভ সরকার মনে করেন, ‘‘আমাদের ভালোভাবে বাংলা ভাষা শেখাতে হবে৷ শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে শেখাতে হবে৷ তা না হলে এই অবস্থা চলতেই থাকবে৷”
তবে দৈনিক সমকালের সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মনে করেন, ‘‘প্রশাসনিক নির্দেশে ভাষার গতি নির্ধারণ করা যায় না, বানান ঠিক করা যায় না৷ এটা মননশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিষয়৷ তবে এই কাজে বাংলা একাডেমি সবচেয়ে বেশি সহায়তা করতে পারে৷”
তিনি বলেন, ‘‘বাংলা ব্যাকরণ তৈরি হয়েছে সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে৷ নিজস্ব বাংলা ব্যাকরণ দাঁড়ায়নি৷ ১৯৩০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি বানান সংস্কার কমিটি করে কাজ করেছিল৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামিল চৌধুরীর নেতৃত্বে বানান সংস্কার করার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছিল৷ তারা কিছু কাজ করেছেন৷ কিন্তু গত ৩০-৪০ বছরে সবাই টাকার পেছনে ছুটছে৷ সব কিছু হচ্ছে আর্থিক লাভের বিবেচনায়৷ নতুন নতুন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে৷ এটা টাকার জন্যই করা হচ্ছে৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না৷ কাজের গুরুত্ব বা আন্তরিকতার চেয়ে কে কত টাকা পাবেন সেটাই চিন্তা৷ এই কারণে তো পাঠ্যপুস্তক বোর্ড লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল৷”
সংবাদমাধ্যমে বাংলা ভাষার বর্তমান হাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘সম্পাদকীয় মনোযোগ না থাকলে বানান নিয়ে নানা ঝামেলা হবেই৷ সেই মনোযোগ কমে যাচ্ছে৷ পত্রিকাগুলোর ভাষা ব্যবহারের স্টাইলের ওপর কোনো জোর নেই৷ যে যেভাবে পারছে চালাচ্ছে৷”