ইইউ’র রাজনৈতিক চরিত্রও কি বদলে যাচ্ছে?
৩০ অক্টোবর ২০১১২৭টি দেশ, একটি রাষ্ট্রজোট৷ শুধু খোলা বাজার নয়, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যরও আরও অনেক বিষয় একই সূত্রে বেঁধে রেখেছে এই দেশগুলিকে৷ তবে কথায় বলে, ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না৷' কয়েক'শো বছর ধরে যুদ্ধবিগ্রহের পর ইউরোপে স্থায়ী শান্তির গ্যারেন্টি দিয়ে চলেছে যে রাষ্ট্রজোট, তার উপকারিতা সম্পর্কে মানুষ আজ বড়ই উদাসীন৷ অভূতপূর্ব এই পরীক্ষা নিরীক্ষার অর্জন সম্পর্কে সন্তুষ্ট না হয়ে পদে পদে খুঁত ধরতেই ব্যস্ত বেশিরভাগ মানুষ৷ এরই মধ্যে চলছে অভিন্ন মুদ্রা ইউরোকে ঘিরে সংকট৷ যে ১৭টি দেশে ইউরো চালু আছে তাদের সরকার তো বটেই, বাকিরাও আশঙ্কায় ভুগছে এই সংকটের কারণে৷ পারস্পরিক নির্ভরতা আজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যে সংকটের এই দুর্দিনে মাথা গরম করে ফেলছেন সদস্য দেশগুলির নেতারা৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের চালিকা শক্তি বলে পরিচিত দেশ জার্মানি ও ফ্রান্স৷ এই দুই দেশের শীর্ষ নেতারাই রাষ্ট্রজোটের চালকের আসনে বসে আছেন৷ বাকিরা কমবেশি তাদের অনুসরণ করছে৷ ইউরো এলাকার ১৭টি দেশ আবার আরও নিবিড়ভাবে পরস্পরের সঙ্গে জড়িত৷ বাকি ১০টি দেশের দুশ্চিন্তা মূলত নিজেদের অর্থনীতি নিয়ে৷ ফলে স্বার্থের সংঘাত অনিবার্য৷ তাই অনেকের মনেই আশঙ্কা জাগছে, যে বর্তমান আর্থিক সংকটের রাজনৈতিক পরিণাম কি ইইউ'র জন্য ক্ষতিকর হতে চলেছে?
জার্মানি ও ফ্রান্স'এর শক্তিশালী অবস্থান ও তাদের নেতৃত্বের দাবি সম্পর্কে খোলাখুলি বিরোধিতা না দেখা গেলেও অপেক্ষাকৃত ছোট দেশগুলির অসন্তোষ কোনো গোপন বিষয় নয়৷ চ্যান্সেলার আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও প্রেসিডেন্ট সার্কোজি যখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ইইউ'র হয়ে কোনো ঘোষণা করেন, সবার পক্ষে তা হজম করা সহজ হয় না৷ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রুডলফ হ্রবেক এপ্রসঙ্গে বললেন, এর ফলে অবশ্যই উত্তেজনার সৃষ্টি হয়৷ একে ঠিক সন্দেহ বা সংশয় বলা চলে না, তবে এটা ঠিক যে ছোট দেশগুলিতে এর ফলে মোটেই উৎসাহ দেখা যায় না৷ তাদের ভয় হয়, যে তাদের যেন নাবালক মনে করে বড়রা তাদের হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছে৷ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তাদের ঘাড়ে সেগুলি শুধু চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷
অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী এই দুই রাষ্ট্রের মতামত যে বাকিদের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে, এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন আরেক অধ্যাপক, এমানুয়েল রিশটার৷ তাঁর যুক্তি হলো, শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ছোট-বড় সব দেশেরই মতামতেরই দাম আছে৷ তিনি বললেন, ইউরোপের দেশগুলি চিরকালই নিজেদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করে এসেছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে নিজেদের সুবিধা বজায় রাখতে ও নিজেদের মতামত প্রতিষ্ঠা করতে তারা সবসময়ে সচেষ্ট৷ আসলে এখনো পর্যন্ত স্বার্থের তেমন কোনো বড় সংঘাত দেখা যায় নি বলে এই বিষয়টি তেমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি৷
এটাও মনে রাখতে হবে যে অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশগুলি শুধু সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় খবরদারি করে না৷ সংকট দেখা দিলে তাদেরই আর্থিক বোঝার সিংহভাগ বহন করতে হয়৷ সেকারণেই তাদের পক্ষে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়৷ সেকারণেই আজ ম্যার্কেল ও সার্কোজি মিলে ইটালির প্রধানমন্ত্রী ব্যার্লুস্কোনি'কে প্রকাশ্যে সাবধান করে দিতে পেরেছেন৷ ইটালিও যাতে গ্রিসের মতো চরম বেকায়দায় না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণের ডাক দিয়েছেন তাঁরা৷ সার্কোজি তো স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, যে নিজস্ব উদ্যোগ না দেখালে সহযোগী দেশের সংহতির আশা ত্যাগ করতে হবে৷ তবে বর্তমান সংকটকে ঘিরে জার্মানি ও ফ্রান্স যে বিশাল চাপের মুখে পড়েছে, তার ফলে সৌজন্যের সীমা প্রায়ই মানা হচ্ছে না৷ আজকাল এমনকি বাকিদের সঙ্গে একেবারে কোনো আলোচনা না করেই ম্যার্কেল ও সার্কোজি রাজনৈতিক দিশা স্থির করে ফেলছেন৷ আসলে সংকটের ফলে ইইউ পার্লামেন্ট বা জাতীয় সংসদগুলি অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে৷ কারণ দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখিয়ে কোনো বিষয়ে ভোটাভুটির সুযোগ তাদের দেওয়া হচ্ছে না৷ ক্ষমতা বেড়ে গেছে মন্ত্রী পরিষদের৷ মোটকথা ‘জোর যার, মুলুক তার' নীতিই প্রাধান্য পাচ্ছে৷ এর ফলে লিসবন চুক্তিও কার্যত লঙ্ঘন করা হচ্ছে৷ বর্তমানে সত্যিই দৃঢ়, স্পষ্ট ও সাহসী পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাঠামোর জন্য এমন অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পরিণাম কী হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে৷
প্রতিবেদন: মারলিস শাউম / সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক