ইতিহাসের মাইল ফলক: ১৯৮৯ সালের ৯ই অক্টোবর
১০ অক্টোবর ২০১৪জার্মানি তথা ইউরোপের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৮৯ সালের ৯ই অক্টোবর একটা বিশেষ দিন৷ সাবেক পূর্ব জার্মানির লাইপসিশ শহরে সেই সোমবার ৭০ হাজার মানুষ জমায়েত হয়ে ক্ষমতাসীন এসইডি দলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রদর্শন করেন; কমিউনিস্ট শাসকদের শোনান জনকণ্ঠের সেই প্রখ্যাত ধ্বনি: ‘‘আমরাই সেই জনগণ''৷ ওপরতলার মানুষরা দেখেন নীচের তলার মানুষদের প্রতিবাদ; পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা যেন ভুলে গিয়েছিলেন, জনতা কি চায়: জনতা চায় স্বাধীনতা, জীবনযাত্রার স্বাধীনতা, সমাজে স্বাধীনতা, ভ্রমণের স্বাধীনতা – বিশেষ করে বিদেশযাত্রার স্বাধীনতা৷ শুধু লাইপসিশ শহরই নয়, হালে কিংবা আইজেনহ্যুটেনস্টাট-এর মতো শহরেও যখন বাসিন্দারা প্রতি সোমবার তাঁদের প্রতিবাদ মিছিল করে চলেছেন – ঠিক তখনই পূর্ব জার্মানির হাজার হাজার নাগরিক দেশ ছেড়ে পালাবার প্রচেষ্টায়৷ জিডিআর-এর মানুষদের এই পথবিপ্লব যেন পদাতিকদের বিপ্লব: পায়ে হেঁটে প্রতিবাদ, পায়ে হেঁটে পলায়ন৷
সে হিসেবে ১৯৮৯ সালের ৯ই অক্টোবর ছিল জার্মান ইতিহাসে একটা মাইল ফলক৷ সে'দিন ৭০ হাজার মানুষ মুক্তভাবে কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানিকে ‘‘না'' বলার সাহস খুঁজে পান৷ যে শান্তিপূর্ণ বিপ্লব এর ঠিক চার সপ্তাহ পরে – ৯ই নভেম্বর তারিখে – বার্লিন প্রাচীরের পতন ঘটায়, সেই বিপ্লবের সূচনা ঘটেছিল লাইপসিশ-এর ঐতিহাসিক ‘‘ডেমো''-য়৷ ঐ চার সপ্তাহ জার্মানি তথা ইউরোপের ইতিহাসে একটা নতুন অধ্যায় সংযোজন করে৷ যে জার্মানদের সম্বন্ধে লেনিন একবার ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন: জার্মানরা যখন বিপ্লবের সময় রেলওয়ে স্টেশনের ওপর অভিযান চালায়, তখনও তারা প্ল্যাটফর্ম টিকিট কেটে তবে ভেতরে ঢোকে৷ কিন্তু সেই জার্মানরাই যে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে, একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে, মস্কোর আধিপত্যের বিরুদ্ধে মধ্য তথা পূর্ব ইউরোপের জাতিসমূহের অভ্যুত্থানে শুধু শামিল হবে না, অংশত পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নেবে, তা কে ভাবতে পেরেছিল? আশির দশকের সূচনায় পোল্যান্ডের সলিডারিটি আন্দোলন যা সূচিত করেছিল, পোলিশ পোপ দ্বিতীয় জন-পল যা-কে আধ্যাত্মিক প্রেরণা দিয়েছিলেন, সেই অগ্নিশিখাই যেন দাবানলে পরিণত হয়ে ঐ ঐতিহাসিক চার সপ্তাহের রূপ নেয়: পোলিশ, চেক, স্লোভাক কিংবা হাঙ্গেরীয়দের মতোই পূর্ব জার্মানির মানুষ সেই ডাকে সাড়া দেন৷ জনগণ উঠে দাঁড়ান, কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্র ধুলিসাৎ হয়৷
৯ই অক্টোবরের দুদিন পরেও জিডিআর জাঁকজমকের সঙ্গে তার ৪০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করে৷ পার্টি ও রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা হয়ত অশনিসংকেত দেখতেও পাননি – যে কারণে সেই শান্তিপূর্ণ অভ্যুত্থান তাদের ইতিহাসের আবর্জনায় পর্যবসিত করে৷ ৯ই অক্টোবর তারিখে পূর্ব জার্মানির মানুষ তাদের স্বকীয় ইতিহাস রচনা শুরু করেন৷ আরো চারটি শান্তিপূর্ণ সপ্তাহ – কিন্তু ক্রমেই আরো বেশি মিছিল ও জনসভা সহ – তার পরেই জার্মানি তথা ইউরোপের বিভাজন দূর হয়৷ ৯ই অক্টোবর জার্মান স্বাধীনতার ইতিহাসের সূচনা, ৯ই নভেম্বরের পথে এক মাইল ফলক৷ এমন একটা দিন, যার জন্য পূর্ব জার্মানির মানুষ, লাইপসিশ শহরের মানুষ গর্ব বোধ করতে পারেন৷ এমন একটা দিন, যেদিনে জনগণ স্বৈরতন্ত্রকে উপেক্ষা করার সাহস খুঁজে পায়৷