ইসলামিক সমাজ, পরিবর্তন ও আতঙ্ক
২৫ এপ্রিল ২০১৯অধ্যাপক কিজিলহান আন্তঃসাংস্কৃতিক মনোবিদ্যা, অভিবাসন ও ইসলাম নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন ধরে৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদ, তরুণ প্রজন্ম, নারী-পুরুষের সমতা ও সামাজিক দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা বলেছেন৷
তরুণ সমাজ সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে কিজিলহান বলেন যে, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে তাদের হতাশাকে অপব্যবহার করছেন উগ্রবাদীরা৷
‘‘তরুণরা আত্মপরিচয় সংকটে ভোগেন৷ তারা প্রশ্ন করেন, ‘আমার পরিচয় কী?' ‘আমি কে?' ‘আমার ধর্ম কী বলে?'', বলেন অধ্যাপক কিজিলহান৷
তিনি বলেন যে, এর সঙ্গে যখন তাদের সামাজিক রাজনৈতিক সংকটগুলো যুক্ত হয়, তখন তারা নিজেদের দুর্বল ভাবেন৷ যেসব দেশে অর্থনৈতিক সংকট প্রকট, শিক্ষার হার কম, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল, সংঘাত চলছে, প্রচুর দুর্নীতি, তখন সেখানকার তরুণ সমাজ এর সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন৷ তারা নিজেদের ও তাদের চারপাশের সমাজকে দুর্বল মনে করেন৷
‘‘তখনই প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনগুলো তাদের শক্তি দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়, তাদের পরিচয় দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, সাম্রাজ্যবাদী দের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি দেয়,'' কিজিলহান ব্যাখ্যা করেন৷ তিনি বলেন যে, বহু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক পরিভাষা ব্যবহার করে এবং কোরআনের উক্তি তুলে ধরে৷
‘‘এতে করে তারা এমন একটি আবহ তৈরি করে যেন ইসলামের নামে এসব সন্ত্রাস করা হচ্ছে, যা একদম সঠিক নয়৷ শুধু তাই নয়, এতে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ইসলামের প্রতি একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়,'' বলেন এই বিশ্লেষক৷
তবে এই তরুণ প্রজন্ম যেন আশাহত না হন, সেক্ষেত্রে তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি৷ বলেন, তাদের কারিগরি শিক্ষা ও খেলাধুলা এসবে উৎসাহী করতে হবে এবং ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের হতাশা নিয়ে গভীর আলোচনা করতে হবে৷ বলতে হবে যে, সহিংসতা কোনো সমাধান নয়৷
‘‘দুঃখজনকভাবে, বিশ্বে ইসলামকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানো হচ্ছে৷ মানুষকে ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে,'' বলেন কিজিলহান৷
ইটালির দক্ষিণাঞ্চল, গ্রিস ও ব্রাজিলের মতো পৃথিবীর অনেক দেশেই পুরুষতন্ত্র একটি সমস্যা বলে মনে করেন কিজিলহান৷ সেসব দেশের মধ্যে অনেক ইসলামি সমাজও রয়েছে৷ সেসব দেশে পুরুষতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে ইসলামকে ব্যবহার করা হয় বলে মনে করেন তিনি৷
‘‘অনেক ইসলামিক সমাজে পুরুষতন্ত্র এতটাই শক্তিশালী যে সেখানে নারীকে সম্পত্তি হিসেবে দেখা হয়, মানুষ হিসেবে নয়৷....এ সব অনেক দেশে অনেক নারীরা শিক্ষা পর্যন্ত পান না এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই৷''
তিনি মনে করেন, নারীকে স্বাধীনতা দেয়া হলে ইসলামের অবমাননা হবে বলে মনে করেন অনেকে৷ ‘অনার কিলিং' বা সম্মান রক্ষার্থে হত্যা অনেক সমাজে সমস্যা বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘এ সব পুরুষতান্ত্রিক ধারণা সম্পর্কে মানুষকে আলোকিত করতে হবে,'' বলেনতিনি৷ ‘‘আমি বিশ্বাস করি যে, ইসলামের দোহাই দিয়ে ‘সম্মান', ‘ধর্ম' ও ‘সংস্কৃতি' রক্ষার নামে হত্যা করা ঠিক নয়৷''
কিজিলহান বলেন যে, ইসলাম একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ এই সংকট মোকাবেলায় যুগ যুগ ধরে চলে আসা ইসলামের কিছু ব্যাখ্যায় পরিবর্তন আনতে হবে৷ তবে এই পরিবর্তন যখনই আসার উপক্রম হয়েছে, তখনই প্রতিক্রিয়াশীলদের উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করেন তিনি৷
‘‘যখন আরব জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হয়, তখন সৌদি আরবে ‘ওয়াহাবি'-দের কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে ‘মুসলিম ব্রাদারহুডের' উদ্ভব ঘটে৷'' এই অধ্যাপক যোগ করেন, ‘‘আজকে অনেক পরিবর্তন এসেছে মুসলিম সমাজে৷ মুসলিম সমাজে ২০, ২৫ বা ৩০ বছর বয়সীদের সংখ্যা পশ্চিমাদের চেয়ে বেড়েছে৷ তারা ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের প্রসারের কারণে এবং তাদের শিক্ষার কারণে যেমন নারী পুরুষের সমতা বা ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়ে সোচ্চার হয়েছে৷''
তিন মনে করেন, তাদের এই চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন কট্টরবাদী চিন্তাভাবনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি করেছে৷ ‘‘এর ফলে সমাজে সংকট তৈরি করেছে৷ ফলে প্রতিক্রিয়াশীল আল-নুসরা, আল-কায়েদা বা ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর জন্ম হয়েছে৷ তারা এ সব পরিবর্তন বিরোধী,'' যুক্তি দেন কিজিলহান৷
তিনি বলেন যে, পৃথিবীর শত কোটি মুসলিম ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে এসেছেন৷ তাই সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের কারণে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন জীবন পদ্ধতি প্রত্যাশা করেন৷ তাই মুসলিমদের ভেতরেই একটা পরিবর্তনশীল স্রোত দেখতে পাচ্ছেন কিজিলহান৷
তিনি বলেন, ‘‘ইরানে দেখুন মেয়েরা পড়াশুনা করছে, গ্রাজুয়েট হচ্ছে এবং ছেলেদের চেয়েও ভালো করছে৷ তারা ডাক্তার, আইনজীবী হতে চান, কিন্তু একইসঙ্গে নিজেদের ব্যক্তি স্বাধীনতা চান এবং পুরুষদের দ্বারা নিগৃহীত হতে চান না৷''
কিজিলহান যোগ করেন, ‘‘এই নারীরা বিভিন্ন দেশে যান এবং দেখেন সেখানকার অবস্থা৷ তারা চার থেকে পাঁচ শতক আগে যেসব নিয়ম তৈরি করা হয়েছিল, সেসব মানতে চান না৷''
তিনি ইসলামিক চিন্তাবিদ ও স্কলারদের একসঙ্গে বসে এসব নিয়ে আলোচনা করার তাগিদ দেন৷ বলেন যে, ইসলামের অপব্যাখ্যা রুখতে এবং মুসলিমদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব যেন না হয়, সে কারণে যুগ যুগ ধরে কিছু কিছু সমাজে ইসলামের যে ব্যাখ্যা চলে আসছে, তার কোনো কোনোটিতে পরিবর্তন আনতে হবে৷
‘‘তা না হলে আমরা মুসলিম সমাজে এমন একটা বিশাল জনগোষ্ঠী দেখতে পাব, যারা নিজেদের সাংস্কৃতিকভাবে মুসলিম তো মনে করেন, কিন্তু ইসলামের পথ অনুসরণ করেন না,'' বলেন ড. কিজিলহান৷
অধ্যাপক ড. ইয়ান ইলহান কিজিলহান একজন মনোবিদ ও প্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যর্গের মেডিক্লিন ক্লিনিকে ট্রান্সকালচারাল সাইকোসোমাটিক্সের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন৷ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাফিউল্লাহ ইব্রাহিমখাইল৷