ব্লগার বনাম পুটিন
৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩একটি লাল স্টিমরোলার মস্কোর টেলিভিশন টাওয়ারটাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে৷ আলেক্সেই নাভালনির ওয়েবসাইট ‘‘দোব্রাইয়া মাশিনা প্রাভদি'' (‘ভালো সত্যের মেশিন') খুললে প্রথম ছবিটাই হলো ক্রেমলিনের প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে সত্যের জয়ের এই প্রতীকী ছবি৷ এই ওয়েবসাইট এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য ওয়েবসাইটে নাভালনি রাশিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতির সমালোচনা করে থাকেন৷
রুশ ‘‘লাইভজার্নাল''-এ তাঁর ব্লগ পড়েন লক্ষ লক্ষ মানুষ৷ সরকারি খরচে দামি-দামি গাড়ি আনান যে সব স্থানীয় নেতা, তাদের থেকে শুরু করে খনিজ তেল অথবা গ্যাসের কোম্পানিগুলির ফন্দিফিকির অবধি – সব কেলেঙ্কারিই ফাঁস করেন নাভালনি – এবং বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে করে আসছেন৷ সেটা আবার এমন একটি দেশে, যে দেশের নাগরিকরা দুর্নীতিকে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে করে৷
নাভালনি তাদের কেলেঙ্কারি ফাঁস করার পর ক্রেমলিনের নিজস্ব দল ‘‘ঐক্যবদ্ধ রাশিয়া''-র একাধিক সাংসদকে তাদের আসন ছাড়তে হয়েছে৷ তাঁর ‘‘দুর্নীতি বিরোধী ফাউন্ডেশন'' প্রতিষ্ঠা করে নাভালনি যে সব ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের চক্ষুশূল হয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনও আছেন৷ জার্মানির ‘‘দি সাইট'' সাপ্তাহিক নাভলনিকে ‘‘পুটিনের বৃহত্তম প্রতিদ্বন্দ্বী'' বলে অভিহিত করেছে৷
ব্লগার থেকে রাজনীতিক
আগামী ৮ সেপ্টেম্বর মস্কোয় মধ্যকালীন মেয়র নির্বাচন৷ নাভালনি সেই নির্বাচনে প্রার্থী৷ এটাই হবে রাজনীতিক হিসেবে তাঁর প্রথম পরীক্ষা – যদিও তাঁর অংশগ্রহণ এ যাবৎ নিশ্চিত নয়৷ গত জুলাই মাসে একটি বিতর্কিত মামলায় তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়: কিরোভ শহরের একটি কাঠগুদামের উপদেষ্টা থাকাকালীন নাভালনি নাকি জুয়াচুরি করেছেন বলে অভিযোগ৷ কিন্তু পরদিনই রায় কার্যকর না হওয়া অবধি তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়, আদালতের আদেশে৷
স্বয়ং রুশ প্রেসিডেন্টের নির্দেশে নাকি তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, বলে সে সময় নাভালনি একটি বেতার সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন৷ ২০১১ সাল থেকেই পুটিন বিরোধী হিসেবে নাভালনির নাম ছড়াতে থাকে, কেননা তিনিই প্রথম শাসকদল ‘‘ঐক্যবদ্ধ রাশিয়া''-কে ‘‘চোর-জোচ্চোরের দল'' বলে অভিহিত করেন৷ নাভালনির দেওয়া নামটা আজ পর্যন্ত খুবই জনপ্রিয়৷ সর্বাধুনিক সংসদীয় এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটে কারচুপির খবরাখবর দেওয়ার যে আহ্বান জানানো হয়, তার পিছনেও ছিলেন নাভালনি৷ হাজার হাজর মানুষ সেই ডাকে সাড়া দেন৷
‘রাশিয়ার একমাত্র সম্ভাবনাপূর্ণ রাজনীতিক'
লম্বা, বিরাট, খোড়োচুল, চোখে পড়ার মতো চেহারা – এভাবেই মার্কিন সাংবাদিক জুলিয়া ইওফ নাভালনিকে বর্ণনা করেছেন৷ জুলিয়া মার্কিন মুলুকের ‘‘নিউ ইয়র্কার'' এবং ‘‘ফরেন পলিসি'' ম্যাগাজিন দু'টির জন্য মস্কো থেকে লেখেন৷ নাভালনির বিষয়েও তিনি অনেক লিখেছেন৷ জুলিয়া ডিডাব্লিউকে বলেন: ‘‘(নাভালনি) হলেন আজকের রাশিয়ার একমাত্র সম্ভাবনাপূর্ণ রাজনীতিক৷'' নাভালনি মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে এসেছেন এবং তাদের দুঃখকষ্ট বুঝতে করতে পারেন৷
নাভালনি প্রথাগত অর্থে রাজনীতিক নন, তাঁর পিছনে কোনো দলও নেই৷ মস্কোয় আইন এবং শেয়ারবাজার নিয়ে পড়াশুনা করেছেন৷ পরে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে কিছুদিন কাটিয়েছেন৷ ২০০০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত নাভালনি রাশিয়ার উদারপন্থি ‘‘ইয়াবলোকো'' দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু কিছু বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়৷
কৌশল ও উচ্চাশা
সে আমলে নাভালনি নিজেকে বর্ণনা করেছিলেন একজন ‘‘যুক্তিসম্পন্ন জাতীয়তাবাদী'' হিসেবে৷ এমনকি তিনি তথাকথিত ‘‘রুশি রূপকথা''-তেও অংশগ্রহণ করেছিলেন: চরম দক্ষিণপন্থিরা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ার জন্য এই সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করত৷ নাভালনি পরে এই সব মন্তব্য ও কার্যকলাপ বর্জন করেছেন, কিন্তু এ-ও যোগ করেছেন যে, রাশিয়ার মতো বহুজাতিক দেশে অভিবাসনের সমস্যা নিয়ে আলোচনায় তিনি দোষের কিছু দেখেন না৷ দৃশ্যত রুশ মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশের মনোভাবও তাই, যে কারণে নাভালনি এই পন্থায় তাদের সমর্থন যোগাড় করার চেষ্টা করেছিলেন, বলে জুলিয়া ইওফে-এর ধারণা৷
ইন্টারনেটের বাইরে বিরোধী নেতা হিসেবে নাভালনির প্রথম আবির্ভাব ২০১২ সালের শীতে অধিকতর গণতন্ত্রের দাবিতে পথ-আন্দোলনে৷ নাভালনি বিক্ষোভের আয়োজন করেন এবং একাধিকবার গ্রেপ্তার হন৷ ২০১২ সালে বিরোধীপক্ষের সমন্বয় পরিষদের নির্বাচনে নাভালনি সর্বাধিক ভোট পান৷ তবে নাভালনির দৃষ্টি আরো দূরে এবং আরো উঁচুতে:
‘‘আমি প্রেসিডেন্ট হবো এবং দেশের জীবনধারা বদলে দেব,'' বলে নাভালনি ঘোষণা করেন এ বছরের বসন্তে৷ তবে তার আগে তাঁকে সরকারি কৌঁসুলির আনা নানা মামলার ধাক্কা সামলাতে হবে৷