কতটা আন্তর্জাতিক কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব?
১৭ নভেম্বর ২০১৪পশ্চিমবঙ্গে এখন সর্বস্তরেই এক ধরনের সংস্কৃতি চালু হয়েছে, যেটা সস্তায় হাততালি কুড়োবার চটকদারি সংস্কৃতি৷ এবারের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখে ঠিক সেটাই মনে হল৷ একটা সময় ছিল, যখন কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সব ধরনের বাণিজ্যিকতা সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হতো৷ শোনা যায়, সেই সময় কোন ছবি উৎসবে দেখানো হবে, সেটাও ঠিক হতো এক ধরনের উচ্চবর্গীয় উন্নাসিক মানসিকতা নিয়ে৷ সাধারণ চলচ্চিত্রপ্রেমীরা তার নাগাল পাবেন কি না, সেই খেয়াল কেউ রাখত না৷
পরিবর্তনের পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌরোহিত্য যেমন অনেক কিছুই নতুন চালু হয়েছে, তেমন কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবও তার ভোল বদলেছে৷ খুব সচেতন প্রচেষ্টাতেও এই উৎসবকে আমজনতার বিনোদন করে তোলার চেষ্টা হয়েছে৷ ফলে ছবি বাছাইয়ের মাপকাঠি বদলেছে৷ মূল ধারার বাণিজ্যিক সিনেমার লোকজনেরা উদ্যোগের সামনের সারিতে এসেছেন৷ গড়পড়তা বাঙালি দর্শকের কাছে অপরিচিত কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার অন্য ধারার সিনেমার কোনও বিখ্যাত পরিচালকের বদলে উৎসবের উদ্বোধন করতে আসছেন আমআদমির নয়নমনি অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খানেরা৷
কিন্তু প্রতিদিন পোলাও বা বিরিয়ানি খেলে যেমন অরুচি হয়, তেমনই প্রতিবার কলকাতার চলচ্চিত্র উৎসবে বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির দুই মহাতারকার উপস্থিতিও ঔজ্জ্বল্য হারায়, সে তাঁরা যত বড় সুপারস্টার হন আর পাবলিক তাঁদের দেখে যতই হইহই করে উঠুক! কারণ, একটা সময় তো সাধারণ বুদ্ধির মানুষের মনে এই প্রশ্নটা আসবে যে, চলচ্চিত্রের কোন সুমহান উৎকর্ষের সন্ধান দিচ্ছে এই তারকা সমাবেশ! শহরে একটা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব করার উদ্দেশ্য তো সেটা নয়৷
যদিও বিনোদন যাঁদের পেশা, সেই তারকারা কিন্তু চেষ্টার কসুর করছেন না৷ অমিতাভ বচ্চন যেমন বললেন, গত বারের উৎসবে তিনি কথা দিয়েছিলেন যে এ বছর সপরিবারে হাজির হবেন তা-ই হয়েছেন৷ স্ত্রী জয়া, পুত্র অভিষেক এবং পুত্রবধূ ঐশ্বর্য রাই বচ্চনকে নিয়ে মঞ্চ আলো করে ছিলেন অমিতাভ৷ এদিকে শাহরুখ খান গতবার কথা দিয়েছিলেন যে এবারে বাংলায় ভাষণ দেবেন, শুরুর বেশ কিছু বাক্য তিনি বাংলাতেই বললেন৷
বলা বাহুল্য, কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শক দুবারই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর মুখেও দেখা গেল তৃপ্তির হাসি৷ কিন্তু বাঙালির চলচ্চিত্রবোধ সেই বিচিত্রানুষ্ঠানের ধারণা থেকে এক ইঞ্চিও এগোল না৷
অথচ এবারের চলচ্চিত্র উৎসবের বিশেষ অতিথি যিনি, অস্ট্রেলিয়ার চিত্রপরিচালক সেই পল কক্সের সঙ্গে নির্ধারিত সাংবাদিক বৈঠক হতেই পারল না, কারণ উদ্যোক্তারাই সময়ে এসে পৌঁছতে পারলেন না! পল কক্স নিজে যদিও ঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন৷ প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর বিরক্ত হয়ে তিনি চলে গেলেন৷ কোনও চলচ্চিত্র উৎসবে এমনটা হচ্ছে ভাবা যায়, বিশেষত যে উৎসব আন্তর্জাতিক স্তরের হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে!
প্রতিবারের মতো এবারও নন্দন, রবীন্দ্রসদনের মূল প্রাঙ্গণ ছাড়াও কলকাতার উত্তরে, পূর্বে ও দক্ষিণে কয়েকটি সিনেমা হলে উৎসবের ছবি দেখানো হচ্ছে৷ উত্তর কলকাতার এমনই এক হলে ছবি দেখতে গিয়ে এক চলচ্চিত্র-উৎসাহীর অভিজ্ঞতা হল, ফরাসি ভাষায় ছবি দেখানো হচ্ছে কোনও ইংরেজি সাব-টাইটেল ছাড়াই! সেই নিয়ে অভিযোগ জানাতে গেলে হল কর্তৃপক্ষ বলে, ওসব ফেস্টিভাল কমিটির ব্যাপার৷ কিন্তু সেই কমিটির কোনও প্রতিনিধি ওই হলে উপস্থিত ছিলেন না৷ অথচ লোকে পয়সা দিয়ে টিকিট কেটেই ছবি দেখতে যাচ্ছেন এবং ৬০ বা ৮০ টাকা নেহাত কম অঙ্কের টাকা নয়!
এবারের উৎসবের উদ্বোধনী ভাষণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, তাঁর রাজ্যে দার্জিলিং, দীঘা, সুন্দরবন, ইত্যাদি প্রাকৃতিক শোভায় পরিপূর্ণ অনেক জায়গা রয়েছে, যেখানে সিনেমার শ্যুটিং হতে পারে৷ অবশ্যই হতে পারে৷ কিন্তু মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি প্রাপ্য সম্মান জানিয়ে বলতে হয়, চলচ্চিত্র আসলে শুধুই নায়ক, নায়িকা, ভিলেনকে নিয়ে শ্যুটিং নয়, আরও অনেক কিছু৷ চলচ্চিত্র উৎসব মানেও শুধু গ্ল্যামার নয়, তারও বেশি কিছু৷ এই অনুধাবনের জায়গাটা সম্ভবত তাঁকে, তাঁর সংস্কৃতি দপ্তরকে নতুন করে তৈরি করতে হবে৷
আর তা না হলে চলচ্চিত্রের সিরিয়াস দর্শকরা বঞ্চিত হবেন, উল্টে গলার জোর বাড়বে নিন্দুকদের৷ এবারই যেমন মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, পরেরবার কোনও জনপ্রিয় বাণিজ্যিক ছবি দিয়ে উৎসব শুরু হবে৷ সোশাল মিডিয়ায় ব্যঙ্গ শুরু হয়েছে, তা হলে কি পাগলু-র মতো কোনও ছবি পরেরবার উদ্বোধনী ছবি হবে!
অথচ মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছার তো অভাব নেই৷ এবারই যেমন বাংলা ছবি সামিল হয়েছে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে৷ এই প্রথম! এত বছরে সেটাও তো কেউ করে দেখাতে পারেননি!