চোরাশিকারিরা বাঘের প্রধান শত্রু
২৬ জানুয়ারি ২০১৬প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল খান দীর্ঘদিন ধরে ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার' নিয়ে গবেষণা করছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, মূলত বাঘের চামড়া, হাড়, নখ এবং দাঁতের লোভেই শিকারিরা তাদের হত্যা করে৷ পরে সে সব জিনিস চড়া দামে দেশে ও দেশের বাইরে বিক্রি হয়৷
ডয়চে ভেলে: সুন্দরবনে এখন বাঘের প্রকৃত সংখ্যা কত?
মনিরুল খান: এর আগে পায়ের ছাপের ভিত্তিতে যখন সংখ্যা গণনা করা হয়েছিল, তখন বাঘের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক ছিল: কিন্তু এখন ‘ক্যামেরা সার্ভে'-র মাধ্যমে বাঘের সংখ্যা নির্ণয় করা হয়েছে৷ এটা নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি৷ এই সার্ভে অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে কম-বেশি ১০৬টা বাঘ আছে৷ এই সংখ্যা থেকে এটা অন্তত নিশ্চিত করে বলা যায় যে, বাঘের সংখ্যা কমছে৷
বাঘের সংখ্যা কমার কারণ কী?
প্রধান কারণ হলো চোরাশিকার (পোচিং)৷ গত কয়েক বছরে সুন্দরবনে বেশ কয়েকবার বাঘের চামড়া এবং হাড় পাওয়া গেছে, যেটা ইঙ্গিত করে যে এখনও সেখানে ‘পোচিং' হচ্ছে৷ এর সঙ্গে সঙ্গে চলছে বনে বাঘের যে প্রধান খাদ্য, সেই হরিণের চোরাশিকার৷ বাঘ শিকারের ফলে সরাসরি বাঘের সংখ্যা কমছে৷ আর হরিণের চোরাশিকারের ফলে বাঘের খাদ্য কমে যাচ্ছে৷ অর্থাৎ বাঘের ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে৷ এতে করে বাঘের ‘ব্রিডিং সাকসেস' এবং ‘সার্ভাইভাল রেট'-ও কমে যাচ্ছে৷ তাই হরিণের সংখ্যা কমলে, এ কথা বলা যেতেই পারে যে শেষ পর্যন্ত বাঘের সংখ্যা কমবে৷
বাঘের চামড়া, হাড়, দাঁত – এগুলো কারা কেনে, কেথায় বিক্রি হয়?
মংলা পোর্ট সুন্দরবনের খুব কাছেই৷ তাই খুব সহজেই জাহাজের মাধ্যমে বাঘের ‘বডিপার্টস' পাচার করা সম্ভব৷ পোচারদের (চোরাশিকারি) কাছে এই বন্দর খুব সহজ একটা ‘অ্যাক্সেস' পয়েন্ট৷ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাঘের চামড়ার ‘ডিমান্ড' আছে৷ অনেক সময় বিদেশিরা এসে এ সব জিনিসের খোঁজ করে৷ আর পোচাররাও সেই সুযোগ নেয়৷ বিদেশে চামড়ার পাশাপাশি হাড়, নখ, দাঁত – এ সবেরও ‘ডিমান্ড' আছে৷ তবে চোরাশিকারির চক্র দেশের ভিতরেও আছে৷ অর্থাৎ স্থানীভাবেও বাঘের চামড়ার চাহিদা আছে৷ না, এখানে যে কোনো ‘অর্গানাইসড গ্যাং' কাজ করছে, সে কথা বলবো না৷ তবে শিকারি এবং পাচারকারীরা বেশ সক্রিয় বাংলাদেশে৷
সুন্দরবনের বাঘের ওপর নানা ক্ষতিকর পরীক্ষা-নীরিক্ষার কথা আমরা শুনি...
রেডিও কলারিং-এর মাধ্যমে একসময় বাঘের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হতো৷ এই পদ্ধতিতে বাঘকে অজ্ঞান করে তার গলার মধ্যে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস লাগিয়ে দেয়া হতো৷ এতে করে প্রত্যেক ঘণ্টায় তার অবস্থান জানা যেত৷ কিন্তু কলার পরানোর পর সুন্দরবনের দু'টো বাঘ মারা যায়৷ তাই তার পর থেকে রেডিও কলারিং বন্ধ করা হয় বাংলাদেশে৷ অন্য পদ্ধতিটা হলো বাঘের ভিডিও ধারণ বা ছবি তোলার জন্য বেইটিং বা টোপ ফেলা৷ বাঘকে খাবারের টোপ দিয়ে কোনো জায়গায় এনে ছবি তোলা৷ এটারও এখন আর অনুমতি আর দেয়া হচ্ছে না৷
বাঘ আর কোন কোন দিক থেকে ঝুঁকির মুখে আছে?
‘সি লেভেল রাইজ', অর্থাৎ সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে সুন্দরবনের বাঘও বিপদে পড়বে৷ এ জন্য এখনই ‘অ্যাডাপটিভ মেজার্স' নেয়া উচিত৷ তাছাড়া চোরাশিকার বন্ধ করা না গেলে সুন্দরবনের বাঘ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, অচীরেই৷
এক্ষেত্রে সরকারের কী করণীয়?
সুন্দরবন ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট'৷ বাংলাদেশের ‘টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান'-এ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে কী কী করতে হবে, তা বলা আছে৷ এবার সেটার বস্তবায়ন দরকার৷ সরকার চেষ্টা করছে, বনবিভাগও চেষ্টা করছে৷ কিন্তু ব্যবস্থাপনাটা এখনও অপ্রতুল৷ অথচ আমরা আন্তর্জাতিকভাবে বাঘ রক্ষায় চুক্তিবদ্ধ৷ প্রথানমন্ত্রী ‘সেন্ট পিটার্সব্যার্গ ডিকলেয়ারেশন'-এ স্বাক্ষর করেছিলেন৷ ভারতের সঙ্গে আমাদের সুন্দরবন নিয়ে চুক্তিও রয়েছে৷ আমরা জাতি হিসেবে বাঘ সংরক্ষণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ৷ আইন আছে, এখন শুধু মাঠ পর্যায়ে এর সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন৷
বাঙালি হিসেবে এই প্রতিজ্ঞা আমরা কীভাবে রক্ষা করতে পারি? জানান আপনার মতামত৷