‘প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন'
২৬ জানুয়ারি ২০১৬গত বছরের জুলাই মাসে ঢাকার রামপুরা থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ পশুর প্রতি নির্দয় আচরণের অভিযোগে তাদের আটক করা হয়৷ এটা ছিল বাংলাদেশে পশুর প্রতি নির্মম আচরণের অভিযোগে প্রথম আইনগত ব্যবস্থা৷
যাদের গ্রেপ্তার করা হয়, তারা হলেন জনি, শুভ এবং ইমরান৷ ‘অভয়ারণ্য' - বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন বা বাংলাদেশ প্রাণী কল্যাণ ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠনের মামলার অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের তখন গ্রেপ্তার করা হয়৷ মামলাটি হয়েছিল রামপুরা থানায়, গত বছরের ১৮ই জুন৷ সেই মামলায় একটি কুকুরকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ করা হয়৷ ফেসবুক-এর একটি ‘পোস্ট' থেকে ঘটনাটি জানতে পেরেছিল সংগঠনটি৷
পুলিশ এই মামলাটি নিয়েছে ‘ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমেল অ্যাক্ট-১৯২০' আইনের অধীনে৷ অভয়ারণ্য-এর প্রধান রুবাইয়া আহমেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা ২০০৯ সাল থেকে ‘অ্যানিমেল রাইট' নিয়ে কাজ করছি৷ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলাটির বিচার আদালতে চলছে৷ তবে আমরা ঐ তিনজনের জেল জরিমানা চাই না৷ আমরা চাই, আদালত যেন তাদের ‘অ্যানিমেল রাইট' বা প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করার আদেশ দেয়৷''
রাজধানী ঢাকায় কুকুরের উপদ্রপ বেড়ে গেলেই আগে নিষ্ঠুর উপায়ে কুকুর নিধন করা হতো৷ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর নিধন দল গভীর রাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কুকুর ধরে তাদের ট্রাকে তুলে হত্যা করত৷ কিন্তু অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন আইনি উপায়ে তা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে৷ তাই গত চারবছর ধরে কুকুর নিধন বন্ধ বাংলাদেশে৷ এছাড়া উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কুকুরের জন্মনিয়ন্ত্রণের৷ এই কাজে সিটি কর্পোরেশনকে সহায়তা করছে ‘অভয়ারণ্য'৷ এ নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে৷
রুবাইয়া আহমেদ জানান, ‘‘২০১২ সাল থেকে আমরা ঢাকায় ১০ হাজারের মতো কুকুরকে জন্মনিয়ন্ত্রণের আওয়তায় এনেছি৷''
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের চিফ ভেটেনারি সার্জন ডা. আজমত উল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের হিসেবে রাজধানীতে ২০ হাজার কুকুর আছে৷ আমরা কুকুর নিধন বন্ধ রেখেছি৷ আমারাও চাই নিষ্ঠুর উপায়ে কুকুর নিধন না করে জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে৷''
বাংলাদেশে প্রচলিত ‘ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমেল অ্যাক্ট-১৯২০'-তে বলা হয়েছে, ‘যদি কেউ পশুকে দিয়ে ক্ষমতার চেয়ে বেশি ভার বহন করায়, বিনা কারণে কোনো পশুর প্রতি নির্দয় আচরণ করে, প্রহার করে অথবা এমনভাবে বেধে রাখে বা বহন করে, যাতে নির্দয় আচরণ স্পষ্ট হয় অথবা নির্দয় আচরণের কারণে কোনো পশুর মৃত্যু হয়, তাহলে এর জন্য দায়ী ব্যক্তির সর্বোচ্চ তিনমাসের জেল এবং ১০০ টাকা জরিমানা হতে পারে৷'
বাংলাদেশে বন্য প্রাণী আইনও কার্যকর আছে৷ ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, বাঘ ও হাতি হত্যা করলে সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা ১০ লাখ টাকা৷ আরো ১২ ধরণের প্রাণী হত্যার জন্য তিন বছরের জেল এবং তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান আছে৷ এই আইনে ১,০৩৭টি প্রাণী এবং উদ্ভিদকে সংরক্ষিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে৷
বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে কাজ করে ‘ওয়াইল্ড লাইফ টিম' নামে একটি সংগঠন৷ এই সংগঠনের সদস্য ইকবাল হোসেন ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে বাঘ পিটিয়ে হত্যার ঘটনা অতীত থেকেই চলে আসছে৷ বন্যপ্রাণী লোকালয়ে চলে আসলেই তাদের ওপর আক্রমণ হয়৷ গড়ে প্রতিবছর ২-৩টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার মানুষের হাতে প্রাণ দেয়৷ এছাড়া হরিণ, বনবিড়াল, ভোঁদর, শিয়াল, মেছোবাঘসহ আরো অনেক বন্যপ্রাণী মানুষের হাতে পড়ে প্রাণ দেয়৷''
তবে তিনি জানান, ‘‘মানুষের মধ্যে সচেতনতাও গড়ে উঠছে৷ ২০১২ সালে সাতক্ষীরার কদমতলীর লোকালয়ে সুন্দরবনের একটি বাঘ চলে আসলে সাধারণ মানুষ বনবিভাগের সহায়তায় তাকে আবার বনে পাঠায়, আক্রমণ করেনি৷ এরপর প্রতিবছরই এরকম ঘটনা ঘটেছে৷ গঠন করা হয়েছে ‘টাইগার রেসপন্স টিম'৷''
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার বা আইইউসিএন-এর বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গৃহপালিত এবং বন্য – দু'ধরনের প্রাণীই নির্দয় আচরণের শিকার হচ্ছে৷ এর একটি কারণ হলো, মানুষ আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে হিংস্র প্রাণীকে আগেই আক্রমণ করে৷ তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো সচেতনতার অভাব৷ অনেকে না জেনেই পশুর প্রতি নির্দয় আচরণ করে৷ প্রাণীরা যে এই পৃথিবীরই সদস্য এবং পৃথিবীর জন্য পরিবেশের জন্য, মানুষের জন্য তাদেরও বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন, তা অনেকেই জানেন না৷''
এরপরও অবশ্য তিনি মনে করেন, ‘‘এখন বাংলাদেশের মানুষ আগের তুলনায় অনেক সচেতন৷ আর সে কারণেই কোথাও একটা সাপ লোকালয়ে এসে ধরা পড়লে, তা সংবাদমাধ্যমে খবর হয়৷ সাপটাকে কীভাবে বনে ফেরত পাঠানো যায়, তা নিয়ে কথা হয়৷ আমরা আহত বা নানা দুর্ঘটনার শিকার প্রাণীকে চিকিৎসা দেয়া, উদ্ধার করার খবরও পাই৷''
বাংলাদেশে পশুর প্রতি নির্মম আচরণ কি আপনারও চোখে পড়েছে? জানিয়ে দিন মন্তব্যের ঘরে৷