করোনার বিধিনিষেধে জার্মানদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
৯ এপ্রিল ২০২০করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় পুরো দেশ লকডাউন বা সান্ধ্যআইন জারি না করলেও দু'জনের বেশি মানুষকে একসঙ্গে চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জার্মানি৷ পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন, স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে৷ এছাড়া সামাজিক দূরত্ব অর্থাৎ ঘরের বাইরে যেকোনো স্থানে একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের দূরত্ব দেড় থেকে দুই মিটার বজায় রাখার নির্দেশনাও জারি করা হয় এবং বন্ধ করে দেয়া হয় সীমান্ত ও জরুরি নয় এমন সব দোকানপাট৷ একইসঙ্গে প্রতি সপ্তাহে বিপুল সংখ্যক মানুষের করোনা টেস্টও করা হচ্ছে৷
জার্মানির উদ্যোগে সন্তুষ্টি, আক্ষেপ
জার্মানির কয়েকজন বাসিন্দা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, জার্মানির এসব উদ্যোগে তারা সন্তুষ্ট৷ দেশটির সাবেক রাজধানী বন শহরের বাসিন্দা আসাদ আহমেদ টিপু এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘জার্মানি যদিও দেরি করে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তবুও খুবই জরুরি ছিল এসব পদক্ষেপ নেয়া৷’’
৪০ বছর আগে উচ্চশিক্ষা নিতে জার্মানিতে আসেন টিপু৷ বর্তমানে তিনি অবসর জীবনযাপন করছেন৷ ডয়চে ভেলেকে টিপু বলেন, ‘‘মানুষের জীবন ব্যবসা থেকে বেশি মূল্যবান৷ তাই জার্মানিতে বর্তমানে কার্যকর নিষেধাজ্ঞাগুলো অতিশীঘ্রই তুলে দেয়া ঠিক হবে না৷ বরং নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখে আরো কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে৷
‘‘কিন্ডারগার্টেন-স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় শীঘ্রই খোলা একেবারেই উচিত হবে না৷ কারণ শিক্ষার্থীরা করোনা ভাইরাসে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও তাদের বাবা মা, দাদা দাদিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ তাদের ক্লাস এক সেমিস্টার পেছালে তেমন কোন ক্ষতি হবে না৷’’
জার্মানির তথ্যপ্রযুক্তিখাতে চাকুরিরত বেলাল ইব্রাহিম জার্মানির নেয়া উদ্যোগগুলোতে বেশ সন্তুষ্ট৷ তিনি বলেন, ‘‘ইউরোপের দেশটি প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই করেছে যেটা আমরা পরিসংখ্যানে দেখতে পাচ্ছি৷ এদেশে করোনায় মৃতের হার অত্যন্ত কম৷’’
তবে, বনের আরেক বাসিন্দা সিন্ডি ব্যাংকমান মনে করেন, করোনা সংক্রমণের হার কমাতে বর্তমান উদ্যোগগুলো কার্যকর হলেও এটাই সঠিক পন্থা কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এমন কোন উদ্যোগ নেয়া দরকার ছিল যা আমাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি বন্ধ না করেও কার্যকর হতো৷ যেমন, এরকম উদ্যোগ যদি নেয়া হতো যে যারা বাড়ির বাইরে যাবে তারা সুরক্ষা মাস্ক ব্যবহার করবে এবং যাদের মধ্যে কোন রকম সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দেবে তারা বাড়িতে থাকবে – তাহলে সবকিছু একেবারে বন্ধ না করলেও চলতো৷’’
জার্মানির মনোচিকিৎসা খাতে কর্মরত এই নারী বলেন, ‘‘জার্মানি সবচেয়ে বড় যে ভুলটা করেছে তাহচ্ছে সময়মতো করোনা থেকে সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ম্যাটেরিয়ালের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত না করা৷ দেশটি এই সংকট একটা লম্বা সময় অবধি গ্রাহ্য করেনি৷’’
সাময়িক আর্থিক ক্ষতি, সহায়তা
মিশর থেকে তিন বছর আগে জার্মানিতে আসা বেলাল স্বীকার করেছেন জার্মানির আরোপ করা বিধিনিষেধের কারণে শুধু আর্থিক নয়, আরো নানাভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছেন তিনি৷ তার কথায়, ‘‘আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ফ্লাইট বন্ধ থাকায় দেশেও যেতে পারছি না৷ তবে, আমি কোন ক্ষতিপূরণ পাইনি, আমার সেটা দরকার নেই৷’’
প্রসঙ্গত, করোনার কারণে আর্থিক ক্ষতির শিকার হওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে সহায়তা করছে জার্মান সরকার, এজন্য বড় অংকের উদ্ধার তহবিলও ঘোষণা করেছে দেশটি৷ জার্মানির গ্রিন পার্টির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ভেয়ার্ল শহরের শাহাবুদ্দিন মিয়া জানিয়েছেন, করোনার কারণে তাঁর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকারের কাছ থেকে নয় হাজার ইউরো ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন তিনি৷ তবে, ব্যবসার ক্ষতি হলেও বর্তমান নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরো বাড়ানোর পক্ষে মিয়া৷
তিনি বলেন, ‘‘এপ্রিলের পরেও নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখতে হবে৷ কারণ আক্রান্তের সংখা কমাতে আরও সময় লাগবে৷ আমার মনে হয় জুন মাসের শেষাবধি সম্ভব হবে৷’’
সদ্য মা হওয়া সিন্ডি ব্যাংকমানের ক্ষতিটা অবশ্য অন্যত্র৷ তার কথায়, ‘‘আমি আমার বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারছি না৷ আমার মা এবং ভাইবোনেরা এখনো আমার সন্তানকে দেখতে আসতে পারেনি৷’’
‘নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন’
জার্মানির রাজধানী বার্লিনের দুই বাসিন্দা করোনা মোকাবিলায় জার্মানির নেয়া উদ্যোগে কিছু ঘাটতি দেখছেন৷ মিতালি মুখোপাধ্যায় মনে করেন, জার্মানি সঠিক সময়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি৷ তিনি বলেন, ‘‘জার্মানির উদ্যোগে ততটা সন্তুষ্ট নই, যতটা হব ভেবেছিলাম৷ ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি প্রথম দিকে থেকেও নুন্যতম প্রাথমিক প্রস্তুতি নিতে পারেনি৷’’
বার্লিনের আরেক বাসিন্দা ওয়ারেসুল মাহবুব জানিয়েছেন, করোনার কারণে জার্মানিতে বিনা নোটিশে চাকুরি হারানোর ঘটনা ঘটেছে যা তিনি অতীতে কখনো দেখেননি৷
বাংলাদেশি এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘‘আমি বেশ কয়েকদিন দেখেছি অনেকেই নিয়ম না মেনে ৩-৪ জন একসাথে ঘোরাফেরা করছেন৷ সেগুলো মনিটর করার জন্য কাউকে দেখিনি৷ এছাড়া অনেকেই বিনা নোটিশে চাকরি হারিয়েছেন৷’’
সিন্ডি ব্যাংকমানের মতে, করোনা সংকট সামগ্রিকভাবে গোটা মানবজাতিকে একটি ধাক্কা দিয়েছে৷ আর এ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা হচ্ছে আমাদের খুব ভালোভাবে তৈরি সামাজিক কাঠামো আসলে অত্যন্ত নাজুক এবং খুব সহজে ভেঙ্গে পড়তে পারে৷ আমাদের তাই ভবিষ্যতে বিভিন্ন সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আরো ভালো পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি নিতে হবে৷’’
উল্লেখ্য, জার্মানির নানা বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে দেশটিতে করোনা ভাইরাসে সংক্রমণের হার কমানো গেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ সরকারি হিসেবে দেশটিতে বুধবার অবধি নিশ্চিতভাবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১০৩,২২৮৷ আর মৃতের সংখ্যা ১,৮৬১, যা মোট আক্রান্তের এক দশমিক আট শতাংশ৷ বেসরকারি হিসেবে অবশ্য আক্রান্ত ও প্রাণহানির সংখ্যা আরো বেশি৷