করোনায় বদলে যাওয়া জার্মানি
২০ মার্চ ২০২০একটিও পাতা নেই, অথচ ফুলে-ফুলে ছেয়ে গেছে পুরো গাছ৷ ঘাসের বুকে ঝাড়বাতির মতো যেন জ্বলছে সাদা ফুল৷ পঞ্জিকার পাতা অনুযায়ী জার্মানিতে আজ, অর্থাৎ শুক্রবার থেকে শুরু হলো বসন্তের দিন গণনা৷ অবশ্য প্রকৃতি তার জানান দিচ্ছিল সপ্তাহ খানেক ধরেই৷ মেঘের আস্তরণ সরে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই আলো ছড়াচ্ছে সূর্য৷ দিনের দৈর্ঘ্যও বাড়ছে ক্রমশ৷ গুমোট শীতের শেষে সময়টা এখন জার্মানদের জন্য উপভোগের, আড্ডা আর ভ্রমণের, সারা বছর চুপচাপ থাকা মানুষগুলোর কিছুটা হৈ হুল্লোড় প্রকাশের৷ অথচ বাইরে তাদের দেখা নেই৷
অফিস ধরার যেই ট্রামে সকাল বেলা বসার আসন পাওয়া যেতো না প্রায়ই, সেটি এখন যাতায়াত করছে হাতে গোণা কয়েকজনকে নিয়ে৷ তারা বসছেন একে অন্যের থেকে বেশ দুরত্ব বজায় রেখে৷
এরই মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বেশিরভাগ কাজ করছেন বাসা থেকে৷ বন্ধ থিয়েটার, সিনেমা হল, পাব, বার, নাইট ক্লাব, জিম, খেলাধুলার আয়োজন থেকে শুরু করে বিনোদনের সব কিছু৷ মার্কেটে জরুরি প্রয়োজনীয় দোকান ছাড়া খুলছে না বাকিগুলো৷ বেঁধে দেয়া হয়েছে রেস্টুরেন্ট খোলা রাখার সময়সীমাও৷ বিকেল বা সন্ধ্যার চেনা বন শহরটি দেখতে কেমন যেন ভূতুড়ে হয়ে উঠেছে৷ শহরের প্রাণকেন্দ্রে বেটোফেনের ভাস্কর্যই শুধু একা দাঁড়িয়ে৷ এমন চেহারা আমার মতো প্রবাসী তো বটেই, জার্মানদের কাছেও নিশ্চয়ই অচেনা৷
এরই মধ্যে জার্মানিতে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে৷ ৪৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন৷
পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা জনগণকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছে সরকার৷ জাতির উদ্দেশে দেয়া বিরল ভাষণে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলও বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়নি এ দেশ৷ চীন বা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সরকারের মতো জনগণের চলাচলের উপর বাধা আরোপের পূর্ব অভিজ্ঞতা তাদের নেই৷ কিন্তু এখন সেটি করতে হচ্ছে৷ এ নিয়ে যেন সরকারের মধ্যেও কিছুটা অস্বস্তি কাজ করছে৷ তাই বিনয়ের সঙ্গে বেঁধে দেয়া নিয়ম মেনে চলতে জনগণের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন ম্যার্কেল তার ভাষণে৷
সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান রবার্ট কখ ইনস্টিটিউট এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, মহামারির এই পরিস্থিতিতে দুই বছর পর্যন্ত ভোগার সম্ভাবনা রয়েছে৷ সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুত করা হচ্ছে সেনাবাহিনীকে৷
এমন পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে অবশ্য জার্মানিতে একটি আইন রয়েছে৷ সেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বিধি ২০০১-এর আওতায় বিভিন্ন জরুরি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে৷ মানুষ অবাধ চলাফেরাসহ যেসব মৌলিক অধিকার বরাবর ভোগ করেন এই আইনের অধীনে সেগুলো কিছুটা রহিত করা সম্ভব৷ এরইমধ্যে সেসব পদক্ষেপও নিতে শুরু করেছে সরকার৷ গণজমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে, করোনায় আক্রান্ত হিসেবে সন্দেহভাজনকে কোয়ারান্টিনে পাঠানো হচ্ছে৷
জার্মানিতে এখন পর্যন্ত একমাত্র বাভারিয়া রাজ্যই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে৷ এর মাধ্যমে অগ্নি নির্বাপক ও বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে নিজেদের অধীনে নিলো রাজ্য সরকার, যা সাধারণত স্থানীয় প্রশাসন বা শহর কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকে৷ বাভারিয়ার সব হাসপাতালও এখন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকবে৷ সেখানকার প্রশাসন চাইলে অবসরপ্রাপ্ত ও সরকারের অধীনে না থাকা ডাক্তারদেরও দায়িত্ব পালনে তালিকাভুক্ত করতে পারবে৷
তবে এখন পর্যন্ত জার্মানির কোনো রাজ্যে কার্ফিউ ঘোষণা করা হয়নি৷ সামনের দিনে সেই আশঙ্কা অবশ্য একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না৷ এরই মধ্যে ফ্রাইবুর্গ ও লেভারকুজেনে দুই সপ্তাহের ‘লকডাউন' ঘোষণা করা হয়েছে৷
জার্মানির আইন অনুযায়ী অভ্যন্তরীন বা বাইরের হুমকি মোকাবিলায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যায়৷ সেটি মহামারি পরিস্থিতিতেও কার্যকর হতে পারে৷ ১৯৬৮ সালে পাস হওয়া আইনটি নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে৷ ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে আবারও নাৎসি একনায়কতন্ত্রের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কা করেন কেউ কেউ৷ এবার যদি সেটি কার্যকর হয়, তাহলে এতদিন ধরে মুক্ত আর স্বাধীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত জার্মানদের অপরিচিত এক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মুখোমুখি হতে হবে৷ গত ৭০ বছরের ইতিহাসে যে ব্যবস্থা কখনো জারি হয়নি ফেডারেল রিপাবলিকটিতে৷