কেমন আছেন যৌনকর্মীরা?
২৩ জানুয়ারি ২০১৭বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের মধ্যে মাদরীপুর, খুলনার ফুলতলা এবং টাঙ্গাইল মিলিয়ে মোট তিনটি যৌনপল্লি উচ্ছেদ করা হয়েছে৷ এর মধ্যে টাঙ্গাইল ছাড়া আর দু'টি এখন বহুতল মার্কেট৷ টাঙ্গাইলের রেজিস্টার্ড যৌনপল্লির যৌনকর্মী হাসি ডয়চে ভেলেক জানান, ‘‘আমাদের নির্মম নির্যাতন আর অত্যাচার করে উচ্ছেদ করা হয়েছিল৷ আমাদের অনেকের নিজেদের জমি ও ঘর থাকার পরও আমরা সেখানে থাকতে পারিনি৷ পরে আদালতের রায়ে আমরা ফিরে আসতে পারলেও সবাই আসেনি৷ তারা এখন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে৷ জানি না তাদের সন্তানরা কেমন আছে, কেমনভাবে চলছে তাদের জীবন৷''
হাসি বলেন, ‘‘আমরা ফিরে এলেও এখন আমাদের ওপর পুলিশের নতুন নির্যাতন শুরু হয়েছে৷ পুলিশ হামলা চালায়, খদ্দের ধরার নামে চাঁদা নেয়৷ ওদিকে বাড়িওয়ালারাও ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে৷ ছোট একটা রুমের একদিনের ভাড়া ৬০০ টাকা৷ তার ওপর মাস্তানদের চাঁদা তো আছেই৷ তাই যৌনকর্মীদের অনেকেরই এখন পেটে ভাত নেই৷ কেউ কেউ ধার-দেনা ও ঋণ করে চলছে৷''
টাঙ্গাইলের যৌনপল্লিকে আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে যাঁরা আন্দোলন করেছেন, তাঁদের মধ্যে সবার আগে আসে মাহমুদা শেলির নাম৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার মনে হচ্ছে, পুলিশ প্রশাসন এখন কৌশলে এই যৌনপল্লিটি উচ্ছেদ করতে চায়৷ তাই খদ্দেররা যাতে আসতে না পারে, সেজন্য তারা নানাভাবে হয়রানি করে৷ খদ্দের না আসলে যৌনকর্মীরা তাদের কাজ টিকিয়ে রাখতে পারবে না৷''
তিনি জানান, ‘‘এই যৌনপল্লিটি উচ্ছেদের পিছনে প্রভাবশালী মহলের হাত ছিল৷ তাদের টার্গেট ছিল এখানকার জমি দখল করা৷ তাই তারা দু'ঘণ্টার মধ্যে যৌনপল্লিটি উচ্ছেদ করেছিল৷''
বাংলাদেশে এখন রেজিস্টার্ড যৌনপল্লির সংখ্যা ১০টি৷ গত দুই দশকে বেশ কিছু যৌনপল্লি উচ্ছেদ হয়েছে৷ নারায়লগঞ্জের টানবাজার এবং ঢাকার ইংলিশ রোডের যৌনপল্লিও এক রাতের মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছিল৷ এই দু'টি যৌনপল্লির যৌনকর্মীদেরও মারপিট ও নির্যাতন করে উচ্ছেদ করা হয়৷ প্রভাবশালীরা প্রশাসনের সহায়তায় এ কাজ করে৷ যৌনকর্মীদের আটক করে ‘প্রিজন ভ্যানে' ভবঘুরে কেন্দ্রে পঠানো হলেও, তাঁরা শেষ পর্যন্ত সেখানে থাকেননি৷ তাঁদের অনেকেই এখন ভাসমান যৌনকর্মী৷
জয়া শিকদার যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা ‘অ্যাক্টিভিস্ট মুভমেন্ট' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান নির্বাহী৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করা হলে তাঁদের ভাসমান না হয়ে উপায় থাকে না৷ তাঁদের বিকল্প পেশা নেই৷ ফলে দিন দিন ভাসমান যৌনকর্মীদের সংখ্যা বাড়ছে৷ তাছাড়া ভাসমান যৌনকর্মীরা স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সুবিধা পায় না৷ ফলে তাঁরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়৷ তাঁদের সন্তানরাও দুর্বিষহ জীবনযাপন করে৷''
বাংলাদেশে ‘গণিকাবৃত্তি' অবৈধ নয়৷ প্রাপ্তবয়স্ক নারী, যাঁদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি, তাঁরা স্বেচ্ছায় ঘোষণা দিয়ে এই পেশা বেছে নিতে পারেন৷ তবে রাষ্ট্র গণিকাবৃত্তি বন্ধে ব্যবস্থা নেবে৷ এখানে জোর করে কাউকে এই পেশায় নিয়োজিত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ তাছাড়া ১৮ বছরের নীচে কোনো নারী এই পেশা বেছে নিতে পারবেন না৷ তবে এই পেশা স্বেচ্ছায় বেছে নিতেও পুলিশকে ঘুস দিতে হয়৷ ২০ হাজার টাকার কমে অনুমতি মেলে না৷
বাংলাদেশে ১০টি যৌনপল্লিতে এবং ভাসমান মিলিয়ে মোট রেজিস্টার্ড যৌনকর্মীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ হবে বলে ধারণা করা হয়৷ ‘সেক্সওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক'-এর আরিফুর রহমান সবুজ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমাদের হিসেবে সারা দেশে ২৫ হাজার ভাসমান এবং যৌনপল্লিগুলোতে ৭০ হাজার বৈধ যৌনকর্মী আছেন৷''
তবে জয়া শিকদার মনে করেন, ‘‘বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে এই সংখ্যা পাঁচ লাখের কম হবে না৷''
বাংলাদেশের যৌনপল্লিগুলোতে বেসরকারি উদ্যোগে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়৷ সরকারি উদ্যোগ তেমন চোখে পড়ে না৷ গত তিন মাস ধরে তহবিলের অভাবে অধিকাংশ এনজিও-র তৎপরতাও বন্ধ আছে বলে জানান মাহমুদা শেলি৷ তিনি আরো জানান, এনজিওগুলোর নানা ধরনের ক্লিনিক থাকলেও স্বাস্থ্য সমস্যাই যৌনকর্মীদের প্রধান সমস্য৷
হাসি জানান, ‘‘যৌনপল্লির স্কুলের পর আরো শিক্ষার জন্য আমাদের সন্তানদের তেমন কোনো সুযোগ নেই৷ বাইরের স্কুলে ভর্তি নিতে চায় না৷ কেউ কেউ পরিচয় গোপন করে সন্তানদের বাইরের স্কুলে ভর্তি করান৷''
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লী রাজবাড়ি জেলার দৌলতদিয়ায় এখন রেজিস্টার্ড যৌনকর্মীর সংখ্যা ১,৫০০ জন৷ তাদের চিকিৎসাসুবিধা দিতে তৎপর ‘পিয়াকট' নামের একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থার সহকারী প্রোগ্রাম অফিসার শেখ রাজিব ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘যৌনকর্মীদের একটি অংশ সিফিলিস এবং গনোরিয়ার মতো যৌনরোগে আক্রান্ত হন৷ তবে এখানে এইডস বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড এখনো নাই, কারণ, এটা পরীক্ষা করার কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি৷''
তিনি জানান, ‘‘দৌলতদিয়া এলকার যৌনপল্লির আশেপাশে প্রায় ৭০টির মতো ওষুধের দোকান-কাম-চিকিৎসা কেন্দ্র আছে৷ সেখান থেকেও তাঁরা চিকিৎসা নেন৷ তবে এখান থেকে তাঁরা যে ওষুধ নেন তাতে রোগ আরো বাড়ে৷''
এই যৌনপল্লিকে ঘিরে জোর করে যৌনকর্মী বানানোর একটি চক্র সক্রিয় আছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানান গোয়ালন্দ থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ৷ তিনি জানান, ‘‘গত এক বছরে আমরা কম করে হলেও ২০ জন নারীকে উদ্ধার করেছি, যাঁদের জোর করে এখানে আনা হয়েছিল৷ দেশের নানা এলাকা থেকে দালালরা তাঁদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে এনে এখানে বিক্রি করে দিয়েছিল৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘ফাঁদে ফেলে এখানে প্রতিজন নারীকে ৪০-৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়৷ তবে আমরা খবর পেলেই তাঁদের উদ্ধার করি৷ এনজিওগুলোও আমাদের তথ্য দেয়৷ এছাড়া আমরা অন্য সোর্সের মাধ্যমে নজরদারি করি৷''
সেক্সওয়ার্কার নেটওয়ার্কের আরিফুর রহমান সবুজ জানান, ‘‘বাংলাদেশের আরো কয়েকটি যৌনপল্লি এখন হুমকির মুখে রয়েছে৷ মঙলার বানিশান্তা এর মধ্যে অন্যতম৷ সেখানে নানা কারণে যৌনকর্মীরা বিপদে রয়েছেন৷ বন্দর জমজমাট না থাকায় যৌনকর্মীদের উপার্জন নেই৷’’ তিনি আরো জানান, ‘‘প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী এখন যৌনকর্মীদের নানাভবে হুমকি দিচ্ছে৷ পুলিশ ও মাস্তানরাও তাঁদের যা আয় তার একটি অংশ কেড়ে নিচ্ছে৷''
মাহমুদা শেলি এবং জয়া শিকদার জানান, যৌনকর্মীরা সারা দেশেই প্রভাবশালীদের হাতে উচ্ছেদের শিকার হন৷ উচ্ছেদের সময় ধর্মকেও ব্যবহার করা হয়৷ তবে উচ্ছেদের মূল কারণ যৌনকর্মীদের সহায়-সম্পদ দখল করা৷ কিন্তু এই উচ্ছেদের মাধমে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েন, পরিণত হন ভাসমান যৌনকর্মীতে৷
বন্ধু, এ বিষয়ে আপনি কিছু বলতে বা জানাতে চান? তাহলে লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷