কার্নেভালে একটা দিন
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫বাদক দলকে ঘিরে দাঁড়িয়ে নাচছে সব বয়সের মানুষ৷ একটা শোভাযাত্রা যাচ্ছে শহরের পুরনো টাউন হলের দিকে৷ স্টেশনের সামনে প্রস্তুতি চলছে তাঁর৷
পুরো শহরই যেন ছুটছে সেদিকে৷ আর কী আনন্দ সবার চোখে মুখে৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে পানশালাগুলোতে ভিড় উপচে পড়ছে৷ এই সাত সকালেই বিয়ার বা মদিরার পাত্র বেশিরভাগের হাতেই৷ শহরও যেন সেজেছে কার্নেভালের সাজে৷ মানুষের ভিড় অনুসরণ করতে করতেই পৌঁছে গেলাম পুরনো টাউন হলে৷ ভেতরে চলছে পার্টির প্রস্তুতি, বাইরে জনতার কোলাহল৷
এখানে নারীদের ভিড়ই বেশি৷ কথা বলে জানতে পারলাম আজকের দিনটিকে বলা যেতে পারে কার্নেভালের প্রমীলা দিবস৷ মেয়েরা বস কিংবা অন্য পুরুষদের টাই কেটে নেবে৷ তবে বিনিময়ে ওই পুরুষটি কপালে জুটবে একটি চুমুও৷ নারীর ক্ষমতায়নের এ এক প্রীতীকি নাটক৷ নারীকে ক্ষমতা দাও....সে তোমাকে দেবে ভালবাসা৷ টাউন হলের ব্যাপারটিও তাই৷ আজ সকাল ১১টা ১১ মিনিটে শহরের মেয়রের কাছ থেকে চাবি কেড়ে নিয়ে টাউন হল দখল করে নেবে নারীরা৷ অবশ্য বিনা উৎপাতেই চাবি দিতে প্রস্তুত হয়েই বসে থাকেন মেয়র৷
টাউন হলের সামনেই এক নারীর কাছে জানতে চাইলাম তিনি কেন এখানে এসেছেন? তিনি বলছিলেন, ‘‘আমার নাম ইয়াসমিন৷ এখানে ভাইবার ফাস্ট নাখটের একটা বড় পার্টি আছে....আমরা এখানে পার্টির জন্যই এসেছি....খাবে দাবো কিছুটা পান করবো ফূর্তি করবো৷''
টাউন হলো নারীদের হাতে ছেড়ে দিয়েই রওনা দিলাম পাশের বিশাল মঞ্চের দিকে৷ মঞ্চের উল্টোদিকে সাংবাদিক প্যাভিলিয়নে দাঁড়িয়ে দেখলাম কয়েক হাজার মানুষ শিল্পীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইছে গলা ছেড়ে৷ এই দৃশ্য এই কোরাস....সামনে থেকে না দেখলে না শুনলে এর মাহাত্য বোঝানো কঠিন৷ সাবই গাইছে..... কোলন আলাফ!!!
চললাম শহরের দক্ষিণ অংশের দিকে৷ অর্থাৎ কোলন স্যুড-এ৷ এখানে বিশাল এক সড়কের মুখে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ৷ ভেতরে যাবে না কোনো গাড়িঘোড়া৷ তরুণ-তরুণীদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে সড়কে ঢুকতেই দেখি এলাহি কাণ্ড৷ হাজার হাজার মানুষ বিচিত্র পোশাক পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে....দলে দলে গান গাইছে নাচছে আর একে অন্যের সঙ্গে ঠাট্টা মশকরা করছে৷ যে কথায় অন্য সময় কেউ ক্ষেপে যেতে পারতো....তাতেও বইছে হাসির ফোয়ারা৷
কিউবান ক্যাফের সামনে কয়েক তরুণ জলদস্যু হাটছে রাস্তায়৷ এমন সাজের কারণ জানতে চাইলে হাসতে হাসতে বললো, ‘‘আমি একজন জলদস্যু....তুমি হয়ত জানো না জলদস্যুতার যা কিছু হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে সেসবের কলকাঠি আমার হাতেই৷''
সাজ কত বিচিত্র হতে পারে তা এই কার্নেভালে না আসলে বুঝতাম না৷ পাকা মিষ্টি কুমড়ো সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছি তিন তরুণী৷ ফল, পাখি, মাছ, মোরগ, গরিলা কী না সেজেছে মানুষ৷ অনেকের সাজের পেছনে আবার আছে বিশেষ বার্তাও৷ একদল তরুণ-তরুণী চিকিৎসক সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ জানতে চাইলে বললো....হাইতির ভূমিকম্পের চিকিৎসক সংকট দেখা গেছে সেখানে৷ দুর্গতরা সময়মতো ওষুধ ও চিকিৎসা পায়নি৷ তাই তারা এই পেশার মহান দায়িত্বের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়৷
একদল ঘুরে বেড়াচ্ছে পোকাসাকড় মারার ওষুধ দেওয়া লোকদের মতো৷ জামায় লোগো ‘ঘোস্ট হান্টার' অর্থাৎ তারা ভূত-তাড়ানোর দল৷ কেন এই সাজ জানতে চাইলে জানালো৷ ওরা মনে করে সমাজ থেকে অসুভ সব শক্তিকে ভূত তাড়ানোর মতো করেই তাড়াতে হবে৷
হঠাৎ চোখে পড়লো ভারতীয়দের মতো শাড়ি পরা এক তরুণী৷ জানতে চাইলাম কেন শাড়ি পড়েছো৷ ও বলছিল, ‘‘আমার বয়ফ্রেন্ড গত বছর ভারতে গিয়েছিল, সেখান থেকে আমার জন্য নিয়ে এসেছে এবং এটা আমার খুব ভালো লেগেছে৷''
হাইডেলব্যার্গের তরুণ অ্যালেক্স সেজেছে তালেবান৷ জানালো লোকে তাকে ওসামা বলে ডাকছে৷ বলল, ‘‘আমি তালেবানের মতো সেজেছি৷ আমি চাইবো সব তালেবানরা কোলনে চলে আসুক আর এই উৎসবে যোগ দিক৷ তারা নিজেদের মুক্ত করুক৷ এতে এক ধরণের আন্তঃসংস্কৃতি যোগাযোগের শুরু হতে পারে৷ আফগানিস্তান এবং জার্মানির৷''
আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখি একদল ছেলেমেয়ে গান গাইছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে৷ দলনেতা বলছিল, ‘‘আমার নাম অ্যন্টনি....গত বিশ বছর ধরে আমি এই কার্নেভালে আসি৷ এটা দারুণ অভিজ্ঞতা৷ প্রতি বছরই দারুণ৷ কোলন আসলেই দারুণ, এই উৎসব চমৎকার৷ সারা বিশ্ব এখানে এসে এক হচ্ছে৷ তোমার এখানে আসা উচিত৷ সবারই আসা উচিত৷''
আমিও কথা দিলাম সুযোগ পেলে অবশ্যই আবারও আসবো এই কোলন কার্নেভালে৷