‘দুই সংস্কৃতির বিসংগতি'
১৩ জানুয়ারি ২০১৬জার্মান সরকার যে উদ্বাস্তুদের পটভূমি সম্পর্কে বিশদ খোঁজখবর ছাড়াই তাদের অবাধে জার্মানিতে ঢুকতে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, জার্মানিতে কর্মরত পাকিস্তানি সাংবাদিক হিসেবে আমি সে বিষয়ে সন্দিহান৷
সিরিয়ার মতো যুদ্ধপীড়িত দেশ থেকে যাঁরা পালাচ্ছেন, যাঁরা একদিকে তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট', অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের হাত থেকে মুক্তি পেতে আকুল, তাঁদের জন্য আমি গভীর সমবেদনা বোধ করি বৈকি৷ কিন্তু একইসঙ্গে এ ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত যে, অভিবাসীদের বিপুল সংখ্যায় আগমন কালে জার্মান সমাজের সামঞ্জস্য ও ভারসাম্যকে ব্যাহত করবে৷ ইসলামি সংস্কৃতি আর ইউরোপীয় নিয়মকানুন বা আদর্শ পরস্পরের সঙ্গে খাপ খায় না, বলেই আমার ধারণা৷
উদ্বাস্তু সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ জার্মান আদর্শ মানবতাবোধ প্রদর্শন করেছেন৷ আমি আমার ইউরোপীয় বন্ধুদের চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের অভিবাসী-বান্ধব নীতি সম্পর্কে সাবধান করে দিতে গেলে, তারা রাগ করেছেন৷ মধ্যপ্রাচ্য অথবা দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা উদ্বাস্তুরা যে জার্মান জীবনযাত্রা ও মূল্যবোধের সঙ্গে মানিয়ে চলবে, বহু জার্মানের এই ধারণাকে আমার একটু সরল মনে হয়েছে৷
আমি আমার বন্ধুদের বলেছি যে, মুসলিম দুনিয়া সম্পর্কে তাদের জ্ঞান সীমিত ও ভ্রান্ত৷ স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা সে কথায় কর্ণপাত করেননি৷
কোলনে থার্টি ফার্স্ট নাইটে যখন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত শত শত তরুণ জার্মান মহিলাদের উপর যৌন হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে, তখন আমার সব শঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়৷ ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের জন্য মুক্ত দুয়ার নীতি খুব বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে কিনা, তা নিয়ে জার্মানরা অবশেষে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন৷ ওদিকে আমি লজ্জায় মরছি৷
আমার পটভূমি মুসলিম; আমি বহু বছর ধরে জার্মানিতে বাস করছি, কিন্তু সর্বদাই ভদ্র-নম্র ব্যবহার পেয়েছি৷ আমি চিরকালই পাকিস্তানের চেয়ে জার্মানিতেই বেশি নিরাপদ বোধ করেছি৷ আমার বহু জার্মান বন্ধু আছেন এবং আমি কোনোদিনই বিচ্ছিন্ন বোধ করিনি৷ কিন্তু থার্টি ফার্স্ট নাইটে মহিলাদের উপর আক্রমণ থেকে আমার এই অনুভূতি হয় যে, আমি নিজেও কোনো না কোনোভাবে ঐ ঘটনার জন্য দায়ী৷ কোলনে যা ঘটেছে, তা তো আমার স্বদেশ পাকিস্তানে নিয়মিত ঘটে থাকে৷ সেজন্য পুরুষরা কিছুমাত্র লজ্জা পায় না, অপরাধবোধ করে না বা অনুশোচনা প্রকাশ করে না৷ কোলনে যারা মহিলাদের উত্যক্ত করেছে, তাদেরও মাথা খারাপ ছিল না; তারা জানতো, তারা কী করছে – এবং তারা সেটা করেছে ইউরোপের সংস্কৃতি, নিয়মকানুন ও এই মহাদেশের মানুষদের প্রতি গভীর অশ্রদ্ধা থেকে; সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত৷
প্রতিশোধ নয়
এখন আমরা চরম-দক্ষিণপন্থি জার্মান গোষ্ঠীগুলির তরফ থেকে তার জবাব পাচ্ছি৷ গত রবিবার সন্ধ্যায় কোলন সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে জনা বিশেকের এক জনতা ছ'জন পাকিস্তানি ও একজন সিরীয়কে আক্রমণ করে – জার্মান মিডিয়ায় আক্রমণকারীদের ‘‘বাইকার, হুলিগান, বাউন্সার'' ইত্যাদি বলে অভিহিত করা হয়েছে৷ অথচ ঘটনাস্থল এমন একটি জায়গা, যেখানে আমি নিজেও মাঝরাত্রির পরে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেরিয়েছি৷
আমিও তো ঐ পাকিস্তানিদের একজন হতে পারতাম৷ হুলিগানরা আমাকে মারার আগে তো আর আমার সাক্ষাৎকার নিত না৷ তারা তো জানতো না যে, আমি একজন নাস্তিক এবং আমি ইসলামি জঙ্গিবাদ সম্পর্কে গত ১৫ বছর ধরে সমালোচনামূলক লেখা লিখে আসছি৷ তারা সেই সব নিয়ে চিন্তাও করত না৷ তাদের কাছে আমি একজন মুসলিম, দক্ষিণ এশীয়, যে তাদের জীবনধারা বদলে দিতে চায়৷
এই আক্রণকারীদের কাজ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হতে পারে, কিন্তু তাদের আশঙ্কাকে অবহেলা করার কোনো উপায় নেই৷ জার্মান সমাজ বদলাচ্ছে, দক্ষিণপন্থি খ্রিষ্টীয় গোষ্ঠী ও ইসলামপন্থি গোষ্ঠীরা দিন দিন আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে৷ জার্মানি তথা ইউরোপের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের পক্ষে যা একটা শঙ্কার বিষয়৷
জার্মান সরকার যদি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি রক্ষা করতে চান, তাহলে যাদের এই সমাজের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলেছে, তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে হবে৷ ‘ইন্টেগ্রেশন' বা অন্তর্ভুক্তি শুধুমাত্র ভাষা শেখার ব্যাপার নয়৷ আমি বহু মুসলিমকে চিনি, যাঁরা দশকের পর দশক ধরে জার্মানিতে বসবাস করছেন, স্বচ্ছন্দে জার্মান বলেন, কিন্তু অন্তরে অন্তরে ধর্মনিরপেক্ষতা ও পশ্চিমি মূল্যবোধ সম্পর্কে গভীর ক্ষোভ পোষণ করেন৷ জার্মানিতে সালাফি আন্দোলন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নব নাৎসিবাদও মাথা চাড়া দিচ্ছে৷
থার্টি ফার্স্ট নাইটে কোলনে যা ঘটেছে, তা জার্মানরা কিভাবে বাঁচে ও তাঁরা বিদেশিদের প্রতি কিরকম আচরণ করে, এ সব কিছু চিরকালের মতো বদলে দিতে পারে৷ সরকারকে দেখতে হবে, তা যেন না ঘটে৷ এবং বিদেশি হিসেবে আমারও একটা দায়িত্ব থাকবে৷
বন্ধু, আপনি কি শামিল শামস-এর সঙ্গে একমত? জানিয়ে দিন আপনার মতামত, নীচের ঘরে৷