‘ক্রসফায়ারের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব নয়’
১৯ মে ২০১৮র্যাব বা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘ক্রসফায়ারে' নিহত প্রত্যেকেই মাদক ব্যবসায়ী৷ মাদক বহনের সময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তারা মারা গেছেন৷ তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এই কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ' বা ‘ক্রসফায়ার' নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে৷ মানবাধিকার কর্মীরা বিভিন্ন ‘ক্রসফায়ারের' নিরপেক্ষ তদন্ত করতে বলছেন বহুদিন ধরে৷ তাদের ভাষ্য, যথাযথ আইনের মাধ্যমেই অপরাধীদের বিচার হতে হবে৷
মানবাধিকার কর্মী, পুলিশের সাবেক প্রধানসহ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্রসফায়ারের মাধ্যমে মাদক সমস্যার সমাধান মিলবে না৷ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ অভিযান এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ ও জনগণকে সচেতন করে সমস্যা কমিয়ে আনা সম্ভব৷
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বন্দুকযুদ্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না৷ এটা একটা পথ, যেটা দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান সম্ভব নয়৷ মাদক ব্যবসা যারা করে, তারা তো ভয়ঙ্কর লোক৷ সে ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে যদি গোলাগুলিতে কেউ মারা যায়, সেটা ঠিক আছে৷ কারা ব্যবসা করছে, কারা এদের মদদ দিচ্ছে, এর মূল খুঁজে বের করতে হবে৷ তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজতে হবে৷''
প্রসঙ্গত, মাদক বিরোধী অভিযানে সর্বশেষ শুক্রবার রাতে যশোরে বন্দুকযুদ্ধে ৩ জন মারা গেছেন৷ ব়্যাব-৬ এর প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বেনাপোল থেকে তারা একটি মোটরসাইকেলে করে অভয়নগরের বাগদাহ গ্রামে যাচ্ছিল৷ এ সময় ব়্যাবের চেকপোষ্টে তাদের চ্যালেঞ্জ করলে তারা গুলি ছোড়ে৷ র্যাবও পাল্টা গুলি ছোড়ে৷ এতে তিন জন মারা যান৷''
তিনি বলেন, ‘‘এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি পালসার মোটরসাইকেল, দুইটি পিস্তল, এক বস্তা ফেনসিডিল, একটি চাইনিজ কুড়াল ও গুলিভর্তি একটি ম্যাগজিন উদ্ধার করা হয়েছে৷ নিহত তিন জনই মাদক ব্যবসায়ী৷''
তবে নওয়াপাড়া পৌর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিম শেখ স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন, ‘‘তার বড় ভাই সহ তিনজনকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ বৃহস্পতিবার তাদের যার যার বাড়ি থেকে সাদা পোশাকে ব়্যাব পরিচয়ে ধরে নেওয়া হয়৷ এরপর কোথাও তাদের খোঁজ মেলেনি৷ শনিবার সকালে তাদের মৃত্যুর খবর পাই৷ আমরা এই হত্যার সঠিক তদন্ত চাই৷''
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার রাজধানীতে পূজা উদযাপন পরিষদের সম্মেলনে শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘সরকার মাদকের বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স' নীতি অবলম্বন করেছে৷''
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী নিহত হওয়ার ঘটনার বিষয়ে প্রশ্ন করলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, ‘‘এসব ঘটনার তদন্ত করা হবে৷ তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে৷''
উল্লেখ্য, গত ৩ মে ব়্যাবের ১৪ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব়্যাব কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন৷ এরপর থেকেই ব়্যাব মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান শুরু করে৷ ১৮ মে পর্যন্ত দেড় হাজার মাদকসেবীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে৷ তবে মূল অভিযান শুরু হয়েছে গত মঙ্গলবার থেকে৷
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে' এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন৷ ব়্যাবের দাবি, নিহত ব্যক্তি একজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী৷ এর আগে সোমবার রাতে ব়্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ ও কুষ্টিয়ায় দুই ব্যক্তি, বুধবার রাজশাহীতে এক ব্যক্তি ও বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রামে দুই ব্যক্তি নিহত হন৷ সর্বশেষ যশোরে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেলেন তিন জন৷
পুলিশ সদরের এক হিসেবে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে দেশে মাদক সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বেড়েছে৷ ২০১৭ সালে মাদক মামলা হয়েছে ৯৮ হাজার ৯৮৪টি৷ ২০১৬ সালে ১৮ হাজার ২৮৭টি, ২০১৫ সালে ৪৬ হাজার ৫১২টি, ২০১৪ সালে ৪২ হাজার ১৯০টি, ২০১৩ সালে ২৯ হাজার ৩৪টি৷ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে প্রতি বছরই মামলা বাড়ছে৷
‘ক্রসফায়ারে' কি মাদক সমস্যার সমাধান সম্ভব? এমন প্রশ্নের জবাবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এভাবে সমাধান মিলবে না৷ সরকার বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সব সময়ই শর্ট-কার্ট পদ্ধতিতে সমাধান চায়৷ যেটা সম্ভব নয়৷ বরং একটা অপরাধ নির্মূল করতে গিয়ে আরেকটা অপরাধের জন্ম দিচ্ছে৷ ফলে মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না৷ আমি মনে করি, আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেই এর সমাধান সম্ভব৷ উৎসগুলো খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে৷''