খালেদা কি দেশে ফিরতে পারবেন?
২ ডিসেম্বর ২০১৭কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে কোথাও দাঁড়ালেই জটলা সৃষ্টি হয়৷ সাংবাদিকদের ক্যামেরা, ট্রাইপড দেখলেই সেখানকার বাসিন্দারা আন্দাজ করে নেন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে৷
এই জটলার বড় অসুবিধা হচ্ছে ছবি বা ভিডিও ঠিকভাবে করা যায় না৷ আবার কাউকে সরে যেতে বললে তিনি মোলায়েম হাসি দিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন৷
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুভূতি বোঝাও মাঝে মাঝে একটু কষ্টকর৷ এক শরণার্থীকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম আপনার বাবামা কোথায়, তিনি হাসতে হাসতে জানালেন তাদের মেরে ফেলেছে মগরা (উগ্রপন্থি বৌদ্ধ)৷
সেই শরণার্থীর হাসি নিয়ে ভেবেছি অনেকক্ষণ৷ সম্ভবত ক্যামেরার সামনে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ হাসি চলে এসেছিল তাঁর, কিংবা এখন আর ভালোমন্দের অনুভূতি কাজ করছে না চরম আতঙ্ক পেরিয়ে আসা মানুষটির৷
খালেদার সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা ভিন্ন৷ কুতুপালং ক্যাম্পে হঠাৎ করে দেখা হয়ে যায় তাঁর সঙ্গে৷ নাম জিজ্ঞাসা করতেই কেঁদে ফেলেন তিনি৷ তারপর একটু সময় নিয়ে বলে যান তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো৷ অল্পসময়ের ব্যবধানে নিজের সম্ভ্রম, সন্তান এবং বাবামাকে খুইয়েছেন তিনি৷ দশদিন ধরে পালিয়ে পালিয়ে কোনক্রমে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন এই নারী৷
খালেদা আর ফিরে যেতে চাননা সেই নরকে৷ চোখের সামনে মৃত্যু দেখে আসা এই নারী এখন থাকেন আরো আটজন মানুষের সঙ্গে ছোট এক তাবুতে৷ খাবার মেলেনা নিয়মিত৷ তবুও আর ফিরবেন না তিনি৷
কুতুপালং ক্যাম্পে খালেদার মতো নির্যাতনের শিকার মানুষ আরো আছেন৷ তবে ধর্ষিত হওয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চান না অনেকেই৷ কিন্তু খালেদা করেছেন, তিনি তাঁর বাবামায়ের হত্যাকারীর, তাঁর সন্তানকে জবাইকারীর, তাঁর ইজ্জত লুটেরাদের বিচার চান মানুষের কাছে, সাংবাদিকদের কাছে৷
তবে বাস্তবতা যে বড় নির্মম৷ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাওয়া, পরা আর চিকিৎসার জোগান দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যতটা তৎপর, যাদের কারণে তাদের এই দশা, সেই মিয়ানমার সরকার আর সেনাবাহিনী সম্পর্কে ততটাই নিরব৷
কুতুপালং ক্যাম্পে তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে৷ সাংবাদিক, বিদেশিদের রাতের বেলা ক্যাম্পে থাকা বারন৷ তাই ফিরে আসার যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন দেখা হলো মোহাম্মদ ইলিয়াসের সঙ্গে৷ সাতবছর আগে শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন তিনি৷ ইতোমধ্যে ভাষাও কিছুটা রপ্ত করে ফেলেছেন৷ কিন্তু সারাদিন করার মতো কোনো কাজ নেই তাঁর৷ বিদেশি সংস্থার দেয়া ত্রাণে পেট চলে যায় ঠিকই তবে নগদ টাকা মেলে না৷ আগে শিবিরের বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারতেন, এখন তাও পারেন না কেননা নিরাপত্তা বেড়ে গেছে৷ ইলিয়াস জানালেন, দেশে ফিরে যেতে চান, তবে নিজের দেশে গিয়ে শরণার্থী হিসেবে থাকতে নয়৷ শুধুমাত্র তখনই যাবেন যখন মিয়ানমার সরকার তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নাগরিকত্ব দেবে৷
ইলিয়াসের কথায় গলা মিলিয়েছেন আরো কয়েকজন শরণার্থী৷ তাদেরও দাবি, নাগরিকত্ব ছাড়া মিয়ানমারে ফিরবেন না তারা৷ বাংলাদেশে হয়ত লেখাপাড়া বা কাজের সুযোগ নেই, থাকতে হয় মানবেতর পরিবেশে, নোংরা নালার পাশে৷ কিন্তু জীবন তো নিরাপদ৷ নিজের দেশে যে সবচেয়ে অনিরাপদ তারা!
আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷