গণতন্ত্রের এই অবস্থা থাকবে না, সঠিক পথে ফিরে আসবে: আলী রীয়াজ
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪বাংলাদেশও তার বাইরে নয়৷ গণতন্ত্রের বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ৷
ডয়চে ভেলে: ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) সম্প্রতি গণতন্ত্রের যে সূচক প্রকাশ করেছে তাতে বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনতি হয়েছে৷ ১৬৫টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫ তম৷ এই সূচক করতে গিয়ে তারা কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়?
আলী রীয়াজ: তারা পাঁচটি দিকে নজর দেয়৷ তার মধ্যে একটা হলো নির্বাচন- নির্বাচন প্রক্রিয়া৷ সেটাকে তারা বহুত্ববাদিতাও বলে৷ সরকার কীভাবে চলে, রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিষয় বিবেচনা করে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা বিবেচনা করে এবং তারা নাগরিক অধিকারের বিষয় বিবেচনা করে৷ এ বছর যেখানে বাংলাদেশের সূচক দাঁড়িয়েছে সেটা গত দুই বছরের চেয়ে কম৷ ২০২১ এবং ২০২২ সালে একই জায়গায় ছিল- ৫.৯৯৷ ২০২৩ সালে অবনতি হয়েছে, স্কোর হয়েছে ৫.৮৭৷ এটাকে তারা বলে হাইব্রিড রেজিম, যেটা সাধারণভাবে দেখতে গণতন্ত্রের মতো৷ কিছু কিছু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেগুলো আসলে কার্যকর নেই। এগুলো আসলে কতৃত্ববাদী শাসন৷
তারা দুর্নীতি, বিচারব্যবস্থা, দুর্বল আইনের শাসন এগুলোও তো দেখে...
তারা যখন ফাংশনিং অব গভর্নমেন্ট দেখে, তখন দুর্নীতি, আইনের শাসন আছে কিনা তা দেখে৷ ইআইইউ-এর প্রতিবেদন গত বছরের তুলনায় দেখলেই হবে না৷ আমি মনে করি, একাধিক বছরের বিবেচনা করতে হবে৷ এ বছর তারা নাগরিকদের অধিকারের ব্যত্যয় বড় করে দেখেছে৷ ২০২১ এবং ২০২২ সালের হিসাব বলছে, নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট ছিল ৫.২৯৷ কিন্তু এখন নেমে এসেছে ৪.৭১-এ৷ তবে শুধু ইআইইউ-এর অ্যাসেসমেন্ট দিয়ে সার্বিক চিত্র পাওয়া যাবে না৷ আরো চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর করে৷ তার একটা হলো ফ্রিডম হাউস৷ মার্চ মাসের শুরুর দিকে তারা প্রকাশ করে, আগেও হতে পারে৷ আরেকটা হলো ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্র্যাসি ইনস্টিটিউট৷ স্টকহোমে আছে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউ ফর ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যসিসট্যান্স(আইডিইএ)৷ অন্যগুলো ইন্ডিপেনডেন্ট বা প্রাইভেট অর্গানাইজেশন৷
যে প্রতিবেদন নিয়ে আমরা কথা বলছি সেটা ২০২৩ সালের৷ এরপর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি একটা নির্বাচন হলো, যে নির্বাচন নিয়ে সারা দুনিয়ায়ই কথা হয়েছে৷ এটা একটা ধারণাগত প্রশ্ন- তারপরও করছি৷ এর পরের প্রতিবেদন কেমন আসতে পারে?
তারা তাদের বিবেচনা করবেন৷ কিন্তু আমি যেটা দেখতে পাই, তা হলো ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্র্যাসি ইনস্টিটিউট এটাকে বলছে ইলোটোরাল অটোক্রেসি৷ নির্বাচন হচ্ছে, কিন্তু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা অটোক্রেটিক শাসন তৈরি করছে৷
বাংলাদেশে এখন ২০২৪ নির্বাচন যে ব্যবস্থায় হলো, সেটাকে আপনি নির্বাচন বলছেন বটে, কিন্তু নির্বাচনের যে কতগুলো ফান্ডামেন্টাল এলিমেন্ট থাকে, সেগুলো ছিল না৷ প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাজানো, নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে৷ ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে যেটা সবাই বলছে না, সেটা হলো, ওয়েপনাইজেশন অব জুডিশিয়ারি হয়েছে৷ আমি এটাাকে এক ধরনের পার্সোনালিস্টিক অটোক্র্যাসি বলে মনে করি৷ ক্ষমতা কেন্দ্রীভুত হতে হতে প্রধানমন্ত্রীর হাতে এককভাবে কেন্দ্রীভুত হয়েছে৷ উনি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বিরোধী দল কে হবে৷ কথিত ইনন্ডিপেডেন্ট যারা, তারা তার বাম হাত না ডান হাত উনি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন৷ ক্ষমতার এই এককেন্দ্রীকরণ, এটাকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় পার্সোনালিস্টিক অটোক্র্যাসি৷
নির্বাচনের আগে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশকেই তৎপর দেখেছি। কিন্তু তারা কি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে? তাদের পলিসি কী?
বাংলাদেশে যদি যুক্তরাষ্ট্র শুধু ভিসা নীতি দিয়ে একটা অবাধ, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমুলক নির্বাচন চায়, সেটা হবে না৷ এটা আমি আগেও বলেছি৷ বাংলাদেশে যারা ভাবছিলেন তারা এটা করে দেবে, আমি তখন থেকেই আপত্তি করেছি৷ আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকার ক্ষেত্রে তার নিজস্ব স্বার্থের বিবেচনা করেছে৷ বাংলাদেশের রাজনীতি ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস, লন্ডন, বেইজিং বা নয়া দিল্লীর হাতে থাকা উচিত নয়৷ বাংলাদেশ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে৷ তাই বাংলাদেশের রাজনীতি এ দেশের মানুষের নিজেদেরই নির্ধারণ করার কথা৷ যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে দীর্ঘ সময়ের জন্য তার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করেছে৷ এটা অপ্রত্যাশিত ছিল না৷ তবে আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে৷ তার ভূমিকা আরো স্পষ্ট হওয়া দরকার ছিল৷
যুক্তরাষ্ট্র যদি মনে করে থাকে শুধু ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমুলক নির্বাচন হবে৷ তাহলে এটা সঠিক ধারণা নয়৷
ওরা বলছে, বিশ্বের মাত্র ২৪টি দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র, ৫০টিতে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, ৩৪টিতে হাইব্রিড আর ৫৯টিতে কতৃত্ববাদী গণতন্ত্র- তাহলে বিশ্বব্যাপী কি গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে?
সামগ্রিকভাবে ২০০৬ সালের পর থেকে গণতন্ত্রের এক ধরনের পশ্চাদপসরণ লক্ষ্য করছি৷ বিশেষ করে দুটি বড় দেশে এটা ঘটেছে, যার মধ্যে ভারত অন্যতম৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সেটা লক্ষ্য করেছি৷ সেটা থেকে যে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে এসেছে তা-ও নয়৷ অন্য বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশের ক্ষেত্রেও সেটা লক্ষ্য করেছি৷ ২০২২ সালের তুলনায় এখন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে৷ তবে কতৃত্ববাদের দিক থেকে পুরোপুরি ফিরে আসা যায়নি৷ এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে৷ অতীতে আমরা দুইবার এই পরিস্থিতি দেখেছি৷ আবার সঠিক পথে ফিরে আসতে দেখেছি৷ এখন এটা থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে৷ তবে এই অবস্থা থাকবে না, সঠিক পথে ফিরে আসবে৷ হয়তো সময় একটু বেশি লাগবে, যে কারণে আমি বলি এটা ( কর্তৃত্ববাদ) আমাদের ডেস্টিনি নয়৷