1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গণতন্ত্র এখন রূপকথার গল্প

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের গণিত চর্চায় বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওপরে উঠতে গিয়ে পিছলে পড়ার অঙ্ক সুপরিচিত৷ এতটাই পরিচিত যে, এটি শুধু একটি অঙ্ক নয়, বরং ধারণা ও মিথে পরিণত হয়েছে৷

https://p.dw.com/p/4cmcI
৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যালট বাক্স নিয়ে যাচ্ছেন নিরাপত্তারক্ষীরা৷
৭ জানুয়ারি ২০২৪ বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ ছবি: Mahmud Hossain Opu/AP Photo/picture alliance

পৃথিবীজুড়ে গণতন্ত্রের যে সঙ্কটাপন্ন অবস্থা তার সাথে বানরের তৈলাক্ত বাঁশে বেয়ে ওঠার মিল খুঁজে পাওয়া যায়৷ বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে তাকালে গণতন্ত্র নিয়ে হান্টিংটনের ‘তৃতীয় জোয়ার’ এবং ফুকুইমারের ‘ইতিহাসের সমাপ্তি' কিংবা ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিজয়'-এর উচ্ছ্বাসকে এখন রূপকথার গল্পই মনে হয়৷ প্রায় দেড় যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের অব্যাহত অবনমন বা পশ্চাৎযাত্রাকে ল্যারি ডায়মন্ড ‘গণতান্ত্রিক মন্দা ও ক্রান্তিকাল’ হিসেবে দেখছেন৷

গণতন্ত্র সূচক তৈরি করে এমন বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য-উপাত্ত বলছে, নানা ধরনের আক্রমণের মুখে বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানগুলো সঙ্কটের মুখে পড়েছে,বিপরীতে দেশে দেশে নতুন ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী হয়ে উঠছে৷ ক্ষমতাসীনরা জনণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পরও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি জলাঞ্জলি দেয়ায় স্বৈরাচারীকরণ বা অটোক্রেটাইজেশনের হার বাড়ছে৷ পাশাপাশি উদারপন্থিদের ব্যর্থতা ও রক্ষণশীল এবং লোকরঞ্জনবাদীদের আকস্মিক ও বিস্ময়কর উত্থান গণতন্ত্রের অব্যাহত পতনের পেছনে কাজ করছে৷ এমন পরিস্থিতিকে গবেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ‘পরিমার্জিত স্বৈরতন্ত্র’, ‘বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র', ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র’ ‘নিয়ন্ত্রিত ও পরিমার্জিত গণতন্ত্র’ ইত্যাদি নানা নামে আখ্যায়িত করেছেন৷ যে নামেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন এটি সত্যি যে, গণতান্ত্রিক মন্দাদশা দিন দিন বাড়ছে, বিপরীতে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার প্রসার ঘটছে৷

বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক যাত্রার আলোচনায় ‘দ্য থার্ড ওয়েভ : ডেমোক্রেটাইজেশন ইন দ্য লেট টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি' বইয়ে উল্লেখিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল ফিলিপস হান্টিংটনের তিনটি জোয়ারের কথা এসে যায়৷ ১৮২৮ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত প্রথম জোয়ারে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ বিশ্বের ২৯টি দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছিল৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় জোয়ার শুরু হয়েছিল৷ হান্টিংটনের মতে, গণতন্ত্রের তৃতীয় ও শেষ জোয়ারটি ছিল ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত, যখন দক্ষিণ ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও বিভিন্ন কমিউনিস্ট দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে৷ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা ১৯৯২ সালে 'ইতিহাসের সমাপ্তি' টেনে যখন ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিজয়' ঘোষণা করেছিলেন তখন গণতন্ত্র রথের উল্টো যাত্রা বা বিপরীত ঢেউয়ের কথা আমাদের ধারণার মধ্যেই ছিল না৷ হান্টিংটনের প্রথম থেকে দ্বিতীয় এবং দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় জোয়ারে উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যবর্তী সময়টুকুতে গণতন্ত্রের বিপরীত ঢেউ আমাদের কাছে দেখা দিলেও আমরা তা নিয়ে কখনই চিন্তিত ছিলাম না৷ ২০০৭ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ১৫ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব গণতান্ত্রিক দিবস ঘোষণার আগে থেকেই আমরা লক্ষ্য করতে শুরু করলাম, বিশ্বব্যাপী শুধু গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা কমছেই না, উপরন্তু যেসব দেশে বহু বছর ধরে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত ছিল সেসব দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাপকভাবে আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে৷ ফলে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার প্রসার ঘটেছে৷ 

বিশ্বব্যাপী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নানা তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে গণতন্ত্রের সূচক তুলে ধরার জন্য বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে৷ এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লন্ডন ভিত্তিক সাময়িকী ইকনোমিস্টের গবেষণা শাখা ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ), ওয়াশিংটন ভিত্তিক ফ্রিডম হাউস এবং সুইডেনের গুটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি ইন্সটিটিউট (ভি-ডেম) অন্যতম৷ ইআইইউ'র সবশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি৷ বিশ্বের ১৬৭টি দেশ ও অঞ্চলের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, গণতন্ত্রের বৈশ্বিক গড় সূচক ২০২২ সালে ছিল ৫.২৯, যা ২০২৩ সালে কমে দাঁড়ায় ৫.২৩-এ৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালের পর থেকে গণতন্ত্র সূচকের এই পশ্চাৎপদতা ও স্থবিরতা অব্যাহত আছে৷ ২০২৩ সালের ৯ মার্চ ফ্রিডম হাউসের প্রকাশিত 'বিশ্বে স্বাধীনতা ২০২৩: গণতন্ত্রের সংগ্রামে ৫০ বছর পূর্তি' শীর্ষক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, টানা ১৭ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতা হ্রাস পাওয়ার কারণে গণতন্ত্রের ধারাবাহিত অবনমন ঘটছে৷ ইআইইউ'র প্রতিবদনে সূচকগুলোর ভিত্তিতে দেশ ও অঞ্চলগুলোকে ৪টি ভাগে ভাগ করে গণতান্ত্রিক অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে৷ এগুলো হলো পূর্ণ গণতন্ত্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, হাইব্রিড বা শঙ্কর শাসনব্যবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা৷ ইআইইউ'র গণতন্ত্র সূচকের পরিমাপ অনুযায়ী, বিশ্বের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি (৩৯.৪%) কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরশাসনের অধীনে বাস করে, যেখানে পূর্ণ গণতন্ত্রে বাস করে মাত্র ৭.৮%৷ ২০১৫ সালে এ হার ছিল ৮.৯%৷ বিপরীতে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, শঙ্কর শাসনব্যবস্থা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা'র অধীন দেশের সংখ্যা বেড়েই চলেছে৷ গত বছরের মার্চে প্রকাশিত ভি-ডেমের প্রতিবেদন আরও ভয়ঙ্কর তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরে৷ সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭২ শতাংশ অর্থাৎ ৫৭০ কোটি মানুষ স্বৈরশাসনের অধীনে বাস করছে৷ বিশ্বের ১৭৩টি দেশের মধ্যে ৮৫টি দেশে গণতন্ত্র সংকটের মুখে আছে৷ আশঙ্কার তথ্য হলো, ২০২২ সালে গড় বিশ্ব নাগরিক যে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা উপভোগ করছেন তা ১৯৮৬ সালের স্তরে নেমে গেছে৷

Bangladesch | Wahlen | Talkshow
মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ছবি: bdnews24.com

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ল্যারি ডায়মন্ড এমন পরিস্থিতিকে ‘গণতন্ত্রের মন্দা' বলেই ক্ষান্ত হননি৷ তিনি মনে করেন, শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র এখন এমন এক ক্রান্তিকালে আছে যেখান থেকে এর মৃত্যু ঘটতে পারে বা এটি পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে৷ এমন আশঙ্কা আরো অনেকেই করেছেন৷ এর পেছনে দায়ী বেশ কিছু কারণ বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে৷ বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার ব্যাপক প্রসারের কারণে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের ওপর ক্রমাগত আক্রমণের ঘটনা বাড়ছে৷ যে কারণে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর ওপর জনগণের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে৷ বিশ্বব্যাপী স্বৈরশাসকরা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে নিজেদের মত করে ব্যবহার করছে৷ আবার চীন ও রাশিয়ার মত বড় বড় কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর আগ্রাসী মনোভাবের কারণে অনেক ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আরও বেশি সঙ্কটের মুখে পড়ছে৷ বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার প্রসারে ‘আগুনে ঘি ঢালা'র মতো কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়া-আফ্রিকায় দক্ষিণপন্থী লোকরঞ্জনবাদীদের (পপুলিস্ট) আকস্মিক জোয়ার৷ লোকরঞ্জনবাদীরা একদিকে জাতীয়তাবাদের আড়ালে বিদেশি ভীতি বা জেনোফোবিয়া এবং ইসলামফোবিয়াকে অন্যদিকে গণতন্ত্রের পরিবর্তে উন্নয়নের মন্ত্রকে উস্কে দিচ্ছে৷ তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আবেগকে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যব্যহার করছে৷ ফলশ্রুতিতে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি ও স্বাধীন চিন্তা সংকুচিত হয়ে পড়ছে, দেশে দেশে বাড়ছে অসহিষ্ণুতা৷ তুরস্ক, ভেনেজুয়েলা, মিসর, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ফিলিপাইনে এমনটা ঘটতে দেখা গেছে৷       

বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর গণতন্ত্রের সূচক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ৫টি বিষয় বিবেচনা করা হয়৷ সেগুলো হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, সরকারের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং নাগরিক স্বাধীনতা৷ পৃথিবীজুড়ে যেসব দেশে গণতন্ত্রের অবনমন ঘটেছে বা ঘটছে সে দেশগুলোতে এই পাঁচটি বিষয়ের ওপর ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য বিস্তার করতে দেখা যায়৷ বিশ্লেষকরা মনে করেন, নতুন শতাব্দীতে অনেক দেশেই নামমাত্র গণতন্ত্র রয়েছে৷ সরাসরি সামরিক সরকার না থাকলেও পর্দার আড়ালে অনেক দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারগুলো সামরিক একনায়কের মতই আচরণ করে৷ যাদেরকে ‘সিভিলিয়ান অটোক্র্যাট‘ বা ‘বেসামরিক স্বৈরশাসক‘ বলা হচ্ছে৷

মোটামুটিভাবে একটি সাধারণ ধারণা হলো, জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রতিনিধিত্ব, দায়বদ্ধতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে কোনো শাসনব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলা যায় না৷ বৃহত্তর পরিসরে এই চারটি সূচকের প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের সহজ ও সাবলীল প্রক্রিয়া বজায় থাকা৷ কিন্তু নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা হলেও ক্রমপ্রসারমান কর্তৃত্ববাদী শাসকরা নির্বাচনকেই নিজেদের ক্ষমতাগ্রহণের বৈধতা দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে৷ ১৯৬৫ সালে কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ‘গণতন্ত্রে যে দুটি জিনিস একান্ত আবশ্যক – যে দুটি না হলে ওটা গণতন্ত্রই নয় – সে দুটির একটি হচ্ছে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন, অপরটি নির্বিবাদে ক্ষমতা হস্তান্তর৷‘ এখন যেসব দেশে বেসামরিক একনায়কতন্ত্র বিদ্যমান সেসব দেশে নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে৷ কিন্তু সেগুলোতে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটার সুযোগ থাকছে না৷ উল্টো হান্টিংটনের ‘টু টার্নওভার টেস্ট‘ এখন একনায়কদের ক্ষমতায় টিকে থাকার মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ সে কারণে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ‘দি ইস হাউ ডেমোক্রেসিজ ডাই‘ শীর্ষক কলামে স্টিভেন লেভিটস্কি এবং ড্যানিয়েল জিবলেট বলেছেন, আজকের দিনে গণতন্ত্রের উল্টোযাত্রা শুরু হয় ব্যালেট বাক্সে৷ কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে নানা কৌশলের মাধ্যমে নির্বাচনের জন্য অযোগ্য করে দেন৷ ফলে সংসদে কোনো কার্যকর বিরোধী দল থাকে না৷ দীর্ঘমেয়াদে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এসব কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় ধীরে ধীরে ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে পুঞ্জীভূত থাকছে৷ এরিকা ফ্রাঞ্জ একে ‘ব্যক্তিবাদী একনায়কতন্ত্র‘ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যেখানে তার কর্মকাণ্ডগুলো ‘গণতন্ত্রের মৃত্যুর পথ‘ রচনা করে৷ বেসরকারি একনায়করা জনগণের মতামতকে সহিংসভাবে নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘমেয়াদি চেষ্টা করে৷ ফলে জনগণ সরকারের সমালোচনা করার সাহস হারিয়ে ফেলে৷ একসময় রাজনীতি ও দেশের শাসনব্যবস্থার প্রতিই শুধু নয়, জনগণ ভোটদানের উৎসাহও হারিয়ে ফেলে৷ এক্ষেত্রে দমন-নিপীড়নের কাজে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে ব্যবহার করা হয়৷ উপরন্তু রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্ব বেড়ে যায়, যে কারণে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বেড়ে যায়৷ রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক একনায়কের অস্তিত্ব পোক্ত হয়৷ কারণ এর মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী নেতার ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়৷ স্টিভেন লেভিটস্কি এবং ড্যানিয়েল জিবলেট বিষয়টিকে তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘‘নির্বাচিত স্বৈরশাসকরা গণতন্ত্রের একটা লেবাস বজায় রেখেই গণতন্ত্রকে ছিড়েফুঁড়ে খায়৷ তারা এমন ভান করে যে তাদের হাতেই গণতন্ত্র রক্ষা পাচ্ছে৷’’

একদিকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের ব্যাপক প্রসার অন্যদিকে লোকরঞ্জনবাদীদের বিস্ময়কর উত্থান গণতন্ত্রের অস্তিত্বকে সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে৷ ‘কীভাবে গণতন্ত্রের বিনাশ হবে‘ বইতে ডেভিড রাঞ্চিম্যান মন্তব্য করেছেন, গণতন্ত্র হয়তো মারা যাচ্ছে না, তবে তাকে মধ্যবয়সের সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে৷ প্রযুক্তির প্রসারে বিশ্ব যতই এগিয়ে যাচ্ছে, গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নিয়ে মানুষের শঙ্কা ততই বাড়ছে৷ কারণ দেড় যুগ ধরে গণতন্ত্রের অবনমনের ধারা অব্যাহত আছে৷ ধারাবাহিক পতনের মধ্য দিয়ে যে গণতন্ত্র বিশ্বব্যাপী টিকে আছে সেটি পুষ্টিহীনতায় ভরা, রুগ্ন আর জরাজীর্ণ৷ সার্বভৌমত্ব, প্রতিনিধিত্ব, দায়বদ্ধতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমন্বয়ে যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন মানুষ দেখে সেটি শুধুই এখন একটি স্বপ্নমাত্র৷ অনেকটা রূপকথার গল্পের মতো, যা ভেবে মানুষ সুখ পেতে পারে, অপেক্ষায় থাকতে পারে৷ কিন্তু তাকে পাওয়ার বা ছুঁয়ে দেখার সম্ভাবনা যেন সুদূর পরাহত৷  

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য