গরিব পাচ্ছে না করোনার টিকা, ধনী পাচ্ছে বুস্টার
২৪ ডিসেম্বর ২০২১মাস কয়েক আগে ডাব্লিউএইচওর মহাপরিচালক টেড্রস অ্যাডানম গেব্রেয়েসাস একটি আহ্বান জানিয়েছিলেন৷ বিশ্বের প্রতিটি দেশের অন্তত ৪০ শতাংশ জনগণ করোনার অন্তত এক ডোজ টিকা না পাওয়ার আগে যেন কোনো দেশ টিকাপ্রাপ্ত ও স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিদের বুস্টার না দেন সেই অনুরোধ করেছিলেন তিনি৷ বুধবার তিনি জানান, এখনও আফ্রিকার চারজন স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে তিনজনই টিকা পাননি৷
জাতিসংঘের সংস্থা ডাব্লিউএইচও অনেকদিন ধরেই টিকাদান কর্মসূচিতে বৈষম্য নিয়ে সোচ্চার৷ তাদের যুক্তি, করোনা ভাইরাসকে কিছু জায়গায় ইচ্ছেমত ছড়ানোর সুযোগ দিলে নতুন ও আরও মারাত্মক সংস্করণ তৈরির সুযোগ হয়৷
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করা সংস্থা গ্লোবাল চেঞ্জ ডাটা ল্যাবের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা’ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিশ্বের ৫৭ শতাংশ মানুষ করোনার অন্তত এক ডোজ টিকা পেয়েছেন৷ কিন্তু নিম্ন আয়ের দেশে বাস করা মাত্র ৮.১ শতাংশ মানুষ অন্তত এক ডোজ টিকা পেয়েছেন৷
টিকাদান ক্ষেত্রে এমন বৈষম্যের মধ্যেই ওমিক্রন সংস্করণের আগমন ঘটায় সামর্থ্যবান দেশগুলো বুস্টার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে এখন পর্যন্ত ১২০টির বেশি দেশ বুস্টার কিংবা অতিরিক্ত ডোজ টিকা দেয়া শুরু করেছে, যার একটিও কম আয়ের দেশ নয়৷
বুস্টার কেন প্রয়োজন?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি (এমা) মঙ্গলবার জানিয়েছে, বর্তমানে যে টিকাগুলো আছে সেগুলো ওমিক্রনের বিরুদ্ধে ঠিক কতটা কার্যকর সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি৷
তবে ওমিক্রনকে পরাস্ত করতে বর্তমান টিকাগুলোর সামর্থ্যে ঘাটতি পাওয়ার কথা জানিয়েছেন সংস্থার ভ্যাকসিন স্ট্র্যাটেজি বিভাগের প্রধান মার্কো কাভেলারি৷ বুস্টার ডোজ সেই ঘাটতি কিছুটা পূরণ করতে পেরেছে বলেও জানান তিনি৷
ওমিক্রনের সঙ্গে লড়তে বর্তমান টিকাগুলোতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে কিনা, এই প্রশ্ন করা হলে এমার প্রধান নির্বাহী পরিচালক এমার কুক বলেন, ‘‘এর কোনো উত্তর নেই৷’’
এদিকে ডাব্লিউএইচওর মহাপরিচালক গেব্রেয়েসাস বুধবার বলেছেন, ‘‘মনে রাখা দরকার যে, (করোনায় আক্রান্ত হয়ে) হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও মারা যাওয়া ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ টিকা না পাওয়া ব্যক্তি, বুস্টার না পাওয়া ব্যক্তি নয়৷’’
ওমিক্রন প্রথম ধরা পড়েছিল সাউথ আফ্রিকায়৷ সেখানে পরিচালিত এক গবেষণা বলছে, ওমিক্রনে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি করোনার আরেক সংস্করণ ডেল্টার চেয়ে ৮০ শতাংশ কম৷ আর হাসপাতালে ভর্তি থাকা ওমিক্রন রোগীদের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার ঝুঁকি ডেল্টার চেয়ে ৩০ শতাংশ কম৷ অবশ্য এই গবেষণার এখনও পিয়ার রিভিউ করা হয়নি৷
বায়োনটেক ও ফাইজারের এক গবেষণা বলছে, তাদের তিন ডোজ টিকা ওমিক্রনের বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম৷ আর দুই ডোজ টিকা মারাত্মক সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে৷
উন্নত দেশগুলোতে ক্রমে বুস্টার বাধ্যতামূলক হচ্ছে
বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাতায়াত করতে করোনার দুই ডোজ টিকা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে৷ তবে ভবিষ্যতে বুস্টার ডোজের প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন৷ মঙ্গলবার তারা করোনার দুই ডোজ টিকা নয় মাস পর্যন্ত স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব করেছে৷ এরপর ভ্রমণ করতে চাইলে বুস্টার ডোজ নেয়া বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেছে কমিশন৷ ১ ফ্রেব্রুয়ারি থেকে এই নিয়ম চালু করতে চায় তারা৷ অবশ্য এই নিয়ম কার্যকর করতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অনুমোদন প্রয়োজন৷
তবে ইতিমধ্যে ফ্রান্সসহ ইইউর কয়েকটি দেশ বুস্টারের গুরুত্ব বাড়িয়েছে৷ ফ্রান্স বলছে, প্রাপ্তবয়স্করা টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার সাত মাস পর আরেকটি ডোজ না নিলে তাদের কোভিড সার্টিফিকেট অকার্যকর হয়ে যাবে৷ ১৫ জানুয়ারি থেকে এই নিয়ম চালু করবে ফ্রান্স৷
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো ও ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বুস্টার ডোজ নেয়া বাধ্যতামূলক করেছে৷
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া কর্তৃপক্ষও স্বাস্থ্য, বয়স্ককেন্দ্র, কোয়ারান্টিন ও মাইনিংসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করা দশ লাখের বেশি কর্মীর জন্য বুস্টার ডোজ বাধ্যতামূলক করেছে৷
এটাই কি শেষ বুস্টার?
বুস্টার কার্যক্রম শুরু করা দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে আছে ইসরায়েল৷ ইতিমধ্যে দেশটি ওমিক্রনের প্রভাব কমাতে স্বাস্থ্যকর্মী ও ষাটোর্ধ্বদের দ্বিতীয় ডোজ বুস্টার দেয়ার পরিকল্পনা করছে৷ অর্থাৎ তৃতীয় ডোজ পেরিয়ে করোনার চুতর্থ ডোজ যুগে ঢুকে পড়ছে ইসরায়েল৷
তাই প্রশ্ন উঠছে, ভবিষ্যতে কি বুস্টার ডোজ নেয়া নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে?
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক অ্যান্থনি ফাওচি মনে করছেন, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ ডোজের পর শরীরে হয়ত এমন সুরক্ষা তৈরি হতে পারে যে কারণে করোনা সাধারণ রোগে পরিণত হতে পারে৷
গরিব দেশের টিকার ব্যবস্থা যেভাবে হচ্ছে
বিশ্বের অনেক দরিদ্র দেশ কোভ্যাক্সের টিকার উপর নির্ভরশীল৷ করোনার টিকার ব্যবস্থা করতে নেওয়া বৈশ্বিক একটি উদ্যোগ হচ্ছে কোভ্যাক্স৷ শুরুতে এই উদ্যোগের আওতায় ২০২১ সালের মধ্যে দুইশ কোটি ডোজ টিকা বিতরণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল৷ পরে সেটা কমিয়ে ১৪০ কোটি ডোজ করা হয়৷ টিকা রপ্তানিতে বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞা, উৎপাদনে চ্যালেঞ্জ ও অনুমোদন দেয়ার ধীর গতি ইত্যাদি কারণে লক্ষ্যমাত্রা কমাতে বাধ্য হয় কোভ্যাক্স৷ এখন পর্যন্ত প্রায় ৭৪ কোটি ডোজ টিকা দিতে পেরেছে কোভ্যাক্স৷
গত জুনে শিল্পোন্নত সাত দেশ গরিব দেশগুলোকে একশ কোটি ডোজ টিকা দেয়ার অঙ্গীকার করেছিল৷ সেটা সরাসরি নির্দিষ্ট কোনো দেশে প্রেরণ কিংবা কোভ্যাক্সের মাধ্যমে দিতে চেয়েছে তারা৷
বাংলাদেশ পরিস্থিতি
‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা’ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ২৭ শতাংশ মানুষ সব ডোজ টিকা পেয়েছেন৷ অন্তত এক ডোজ পেয়েছেন প্রায় ৫৩ শতাংশ৷ ভারতে সংখ্যাটি যথাক্রমে প্রায় ৪০ ও ৬০ শতাংশ৷ আর পাকিস্তানে প্রায় ২৮ ও ৪০ শতাংশ৷
বাংলাদেশে ১৯ ডিসেম্বর থেকে বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে৷ যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি এবং যারা কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারিতে আছেন, তাদের বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে৷ টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ছয় মাস পর বুস্টার ডোজ নেয়া যাবে৷ সেজন্য নতুন করে নিবন্ধনের প্রয়োজন হবে না৷ যারা তৃতীয় ডোজ পাওয়ার যোগ্য তাদের কাছে এসএমএস চলে যাবে৷