গ্রাম্য সালিশ, ফেরদৌসীর লাশ ও কিছু প্রশ্ন
১৭ আগস্ট ২০১১হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারের ঘটনা৷ সেই এলাকার মাধবপুর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের বাসিন্দা ফেরদৌসী বেগম গ্রাম্য সালিশের শিকার হয়ে চলন্ত ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন৷ একা তিনিই নন৷ সঙ্গে তাঁর চার সন্তান ছিল৷ তাঁর স্বামী জিলন মিয়া চাকরিসূত্রে থাকেন দুবাইয়ে৷ ট্রেনর তলায় ঝাঁপ দেওয়ার পর ফেরদৌসী স্বয়ং এবং তাঁর দুই সন্তান আট বছরের বন্যা আর বারো বছরের জীবন সেখানেই মারা পড়ে৷ অন্য দুটি সন্তান, দশ বছরের শাওন আর চার বছরের ঝর্ণা গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে৷
এবার জানা যাক, কীভাবে হল এই পরিস্থিতি৷ আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা এএফপি তাদের খবরে এই ঘটনাটিকে ‘বাংলাদেশ - অপরাধ এবং মানবাধিকার'৷ এই শীর্ষ শিরোনামে রেখেছে৷ বাংলাদেশের সংবাদসংস্থা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম সহ দেশের সবকটি সংবাদপত্র মঙ্গলবারের কাগজে এই ঘটনাটিকে গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে৷ প্রশ্ন উঠেছে নারীর অধিকার এবং এই ধরণের ঘৃণ্য সালিশী সভার যাথার্থ্য নিয়ে৷
প্রশ্ন উঠলেই তো হল না৷ প্রশ্ন হল, এর সমাধানসূত্র কোথায় বা কীভাবে? সে পথের সন্ধানে বেরিয়ে প্রথমে হাইকোর্টে ওঠা একটি মামলার রায়ের দিকে তাকানো যাক৷ রংপুরের বদরগঞ্জে সালিশের মাধ্যমে এক গৃহবধূকে নির্যাতনের ঘটনায় হাইকোর্ট তাঁর রায়ে বলেছেন, এ ধরণের সালিশ-ব্যবসা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে৷ গ্রাম্য সালিশী বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে পুলিশের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷
হাইকোর্ট তাঁর এই রায় জানান গত ৩১ জুলাই৷ তারপরে দুটি সপ্তাহও পেরোয় নি৷ ১৫ই আগস্ট ঘটে গেল হবিগঞ্জে ফেরদৌসীর নির্মম মৃত্যু৷ চলন্ত ট্রেনের বীচে ঝাঁপিয়ে পড়লেন চার সন্তানকে নিয়ে এক মা৷ কারণ, ওই সালিশীর বিচারসভা তাঁকে সমাজচ্যুত করে এবং গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেয়৷ অসহায় অপমানিতা নারীটি আর কোন পথ খুঁজে পাননি৷
অমানবিক এই ঘটনার নেপথ্যপট কেমন ছিল? দেখা যাক, কী হয়েছিল ঘটনাটি আসলে৷ ব্রাম্ভণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার সেজামুরা গ্রামের ফজলুর রহমানের কন্যা ফেরদৌসীর সঙ্গে ১৪ বছর আগে মাধবপুর উপজেলার আন্দিউড়া ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের বাসিন্দা জিলন মিয়ার বিয়ে হয়৷ বছর তিনেক আগে জিলন মিয়া দুবাই চলে যান কাজের জন্য৷ তিনি তাঁর চাচাতো ভাইকাদিরকে বলে যান, তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী ফেরদৌসীকে বাজারহাট করার জন্য সাহায্য করতে৷ সে কারণেই কাদির এই কাজের জন্য যাতায়াত করত ফেরদৌসীর বাড়িতে৷ আর গ্রাম্য মাতব্বররা এটিকেই বিষয় করে তোলে৷ ফেরদৌসীর নামে অপবাদ রটাতে থাকে৷ প্রাথমিক এক বিচারসভায় ইউপি চেয়ারম্যান আতিকুর রহমানের উপস্থিতিতে কোন প্রমাণ না থাকায় বিষয়টি চাপা পড়ে যায়৷ এরপর ফের গত রোববার সুলতানপুরের মাতব্বররা ফেরদৌসীর বিচারে বসেন৷ আতিকুর সে সময়ে ছিলেন না৷ ফলে সহজেই ফেরদৌসীকে একতরফাভাবে দোষী সাব্যস্ত করা সহজ হয়ে যায় মাতব্বরদের পক্ষে৷ তারপরেই এই অসহায় মহিলা আর তাঁর সন্তানদের মৃত্যু৷
এভাবে গ্রাম্য সালিশী সভার বাড়াবাড়ি সমাজে মহিলাদের অবস্থানকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছে যে সে বিষয়ে সব মহলই একমত৷ এখন প্রশ্ন, সমাধানের প্রধান রাস্তা কী প্রশাসন? নাকি, মহিলাদের মধ্যে জাগরণ? অনেকেই মনে করেন, নারীকে স্বয়ং এগিয়ে আসতে হবে৷ তাকে রুখে উঠতে হবে এ ধরণের অনাচারের বিরুদ্ধে৷ আর সে কারণে বাড়ানো প্রয়োজন সচেতনতা৷ সেই সচেতনতার জন্য হয়তো প্রশাসনকেও নিতে হবে কিছুটা দায়িত্ব৷
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ