জনতার কাঁধে বোঝার ওপর শাকের আঁটি
১২ নভেম্বর ২০২১কিন্তু প্রযুক্তি ও তার হাত ধরে মানব সমাজেরও উন্নতির সূত্রে যখন উদ্ভব হতে শুরু করলো নতুন নতুন সমস্যা, তখন নিজেদের স্বার্থেই মানুষকে গড়ে তুলতে হয়েছে রাষ্ট্র নামের একটি ব্যবস্থা৷ সমাজের সকল মানুষের কিছু সাধারণ অধিকার ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র, বিনিময়ে নাগরিকরা রাষ্ট্রকে দেবে সেই ব্যবস্থা চালিয়ে নেয়ার খরচ, রাজস্ব৷ মানুষের সভ্যতার অন্যতম নিয়ামক এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা৷
কিন্তু ইতিহাস বলছে, রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, তারা অনেক সময়ই ভুলে যান এই ব্যবস্থাটির উদ্ভব ঘটেছিল কেন৷ নানা কারণে নাগরিকদের মধ্যে তৈরি হওয়া বৈষম্যকে কমিয়ে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সমতা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তখন দেখা যায় রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডই বরং তৈরি করে নতুন বৈষম্যের ক্ষেত্র৷ সম্প্রতি বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে গণ-পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি এ রকমই এক হঠকারি সিদ্ধান্ত, যা শেষ পর্যন্ত দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপরই সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করছে৷
প্রশ্ন হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকারের করণীয় ছিল কী? বাংলাদেশ জ্বালানি তেল উৎপাদন করে না, আমদানি করে৷ আর বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম এই মুহূর্তে প্রবল গতিতে ঊর্ধ্বমুখী৷ এর প্রভাব তো পড়ারই কথা৷ সরকারও সে কথাই বলছে, বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলেই দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার৷ আসলে ‘বাড়ানো’ শব্দটি ব্যবহার না করে, কায়দা করে বলা হচ্ছে ‘সমন্বয়’ করার কথা৷ কিন্তু এই সমন্বয়ের পেছনে আছে বিরাট বড় ফাঁকি। বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম এই মুহূর্তে ব্যারেল প্রতি ৮০ থেকে ৮৫ ডলারে ওঠানামা করছে৷ এর সঙ্গে পরিবহন ও পরিশোধন খরচ যোগ করলে বড় জোর ১০০ ডলার হওয়ার কথা ১ ব্যারেল তেল আমদানির খরচ৷ এক ব্যারেল প্রায় ১৫৯ লিটারের সমান, যার অর্থ বিশ্ব বাজারে এই উল্লম্ফনের পরেও সরকারের আমদানি করা ১ লিটার জ্বালানি তেলের দাম ৫৪ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়৷ বাড়ানোর আগে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ছিল ৬৫ টাকা লিটার, তাতে সরকারের লোকসান হওয়ার তো কোনো কারণ নেই৷ এখানে আরো মনে রাখা দরকার যে সরকার কিন্তু খোলা বাজার থেকে প্রতিদিন তেল আমদানি করে না, রপ্তানিকারক দেশের সঙ্গে পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে কেনা হয় তেল৷ এই চুক্তি প্রতি মাসে হয় না৷ তার মানে এখন যে জ্বালানি তেল আমদানি করছে সরকার, সেগুলো আসলে কয়েক মাস আগে আমদানি আদেশ দেয়া, যার দাম আরো কম হওয়ার কথা৷ এই কথাই তো বলা হয়েছে কোভিড-১৯ অতিমারীর কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন ব্যারেলপ্রতি ২০ ডলারেরও নিচে নেমে গিয়েছিল তখন৷ গত চার বছরে তেলের দাম হুহু করে কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নেমে এলেও তখন কিন্তু দেশে তেলের দাম কমানো হয়নি৷ কিন্তু এখন বাড়ানো হচ্ছে বিশ্ব বাজারের কথা বলে৷ যদিও বাস্তবতা হলো, ২০১৬ সালে যখন সর্বশেষ ‘সমন্বয়’ করা হয়েছিল তেলের দাম, বিশ্ব বাজারে তখনও দাম বর্তমানের মতোই ছিল, মাঝে কমে যাওয়াতেই এখন মনে হচ্ছে বেড়ে গেছে৷ মাঝের এই চার বছরে কম দামে তেল আমদানি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) সরকারের হিসেবেই লাভ করেছে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা৷ এখন যদি গরিবের ব্যবহৃত ডিজেল আর কেরোসিনে কিছুটা ভর্তুকিও লাগে, সেই লাভের টাকা থেকে কিছুদিন কি সেটা দেয়া যেতো না?
আসলে এই ভর্তুকির হিসেবটাও কিন্তু একটু গোলমেলে। সরকার এই ভর্তুকির হিসেবটা তৈরি করে আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের উপর বিপুল অঙ্কের রাজস্ব যোগ করার পর। সরকার যে তেল ৫৪ টাকা লিটার দরে আমদানি করছে, তার ওপর প্রথমে ৪০ শতাংশ হারে ২২ টাকা আমদানি শুল্ক আদায় করছে। সেটা এবং তার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবহনের খরচ যোগ করলে তবেই বলা যায় যে ৬৫ টাকা লিটার দরে বিক্রি করলে কিছু লোকসান হয়। সেই টাকাটাই ভর্তুকি দিতে হয়। কিন্তু আসলে তো সেটা ভর্তুকি নয়, প্রতি লিটার জ্বালানি তেল আমদানি থেকে যে ২২ টাকা শুল্ক পাচ্ছে সরকার, সেখান থেকেই আসলে ‘সমন্বয়’ করা সম্ভব এই তথাকথিত ভর্তুকি।
পাশের দেশ ভারত কিন্তু ঠিক এই কাজটাই করেছে। কাকতালীয়ভাবে যেদিন বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, ঠিক সেই দিনই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার লিটার প্রতি জ্বালানি তেলের শুল্ক ৫ রুপি হারে কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে তেলের দাম যেদিন বাংলাদেশে বেড়েছে, সেই দিনই খানিকটা কমেছে ভারতে। অবশ্য এটা ঠিক, যে এরপরও ভারতে তেলের দাম বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। তেলের দাম সমন্বয়ের প্রসঙ্গটি উঠলে সরকার ও তাদের সমর্থকদের তরফ থেকে এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়, বলা হয় দেশে তেলের দাম কম থাকলে নাকি চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই যুক্তি খুবই হাস্যকর; সরকারের বোঝা উচিৎ এ কথা বললে তাদেরই ভাবমূর্তির সংকট তৈরি হয় কেননা এর অর্থ হলো সীমান্তে চোরাকারবারি ঠেকানোর সামর্থ্য নেই তাদের, নিয়ন্ত্রণ নেই সীমান্তের ওপর। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথাও বলা প্রয়োজন, জ্বালানির মূল্য বেশি হলেও ভারতে পরিবহন খরচ কিন্তু তারপরও তুলনামূলক অনেক কম। কোলকাতা থেকে দিল্লির দূরত্ব প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার, এই পথে ট্রেনে নন এসি থ্রিটায়ার স্লিপিং আসনের ভাড়া ট্রেনের প্রকৃতি ভেদে ৬৩০ থেকে ৭৬০ রুপি। এসি সুবিধা নিলে এটি ১৭০০ থেকে ২৩০০ রুপির মধ্যে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব মাত্র ৩৪৬ কিলোমিটার, কিন্তু এই রুটে ট্রেনের সর্বনিম্ন ভাড়া ভ্যাটসহ ৩৩০ টাকা, বার্থ সুবিধা নিলে তা দাঁড়ায় ৭৯০ টাকা আর এসি সুবিধা নিতে চাইলে ১৩৫৫ টাকা। অর্থাৎ, দূরত্ব পাঁচ ভাগের এক ভাগ হলেও ভাড়া সমান। বাসের ক্ষেত্রে ব্যবধানটা একটু কম, কোলকাতা থেকে দিল্লি একসারিতে তিন আসনের লাক্সারি বাসের ভাড়া ৩২০০ রুপি, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে লাগে ১১০০ টাকা। তারপরও ভারতের তুলনায় তা অন্তত দেড়গুণ বেশি।
এটা সম্ভব হচ্ছে মূলত ভারতের গণপরিবহন ব্যবস্থার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকায়। বাংলাদেশে সেটা না থাকায় জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির খড়্গটা আরো কয়েকগুণ বেশি শক্তি নিয়ে সোজা গিয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। আসলে বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা যেন পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে এক অশুভ শক্তি। এই শক্তি জ্বালানি তেলের অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ করে না, বরং চায় এই সুযোগে আরো অযৌক্তিক হারে ভাড়া বাড়িয়ে নিজেদের লাভ বাড়িয়ে নিতে! নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সরকারকে চাপে ফেলে সেটা আদায় করে নিতে পারে তারা অনায়াসে, যেমন জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যান চলাচল বন্ধ করে, সারা দেশ অচল করে দিয়ে নিজেদের দাবিটা ঠিকই আদায় করে নিয়েছে তারা। এবং সেখানেও এক শুভঙ্করের ফাঁকিতে পড়েছে জনগণ!
জ্বালানি তেলের মূল্য ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে ভাড়াও বেড়েছে ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ। এটুকু শুনলে কিন্তু ততোটা অযৌক্তিক মনে হবে না, যদিও বাস্তবতা আরো অযৌক্তিক। শতাংশের হিসেবে ২৭ থেকে ৩০, হলেও জনপ্রতি বাসভাড়া টাকার অংকে বেড়েছে সর্বনিম্ন ৩৮ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ পয়সা পর্যন্ত। অথচ, প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধির ফলে জ্বালানি খাতে একটি বাসের প্রতি কিলোমিটারে খরচ বেড়েছে আসলে ৩.৭৫ টাকা (লিটারে ৪ কিমি চলবে ধরে নিয়ে); মানে ৩২ সিটের একটি বাসে ঠিক ৩২ জনই যাত্রী থাকলে জনপ্রতি সর্বোচ্চ ১২ পয়সা! মানেটা দাঁড়ালো, সরকারের সামান্য একটু লাভ কমে যাওয়া ঠেকাতে গিয়ে জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হলো বোঝার ওপর শাকের আঁটিটাও।
অথচ, অতিমারির এই দুই বছরে আয় হারিয়ে সরকারের চেয়েও কঠিন অবস্থায় রয়েছে এই সাধারণ জনগণ। রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি সভ্যতার অনুসঙ্গ হয়ে থাকে, তাহলে তো রাষ্ট্রের কোনোভাবেই এই রকম আচরণ করা উচিত নয়! কারণ, তার কাজটা তো আসলে সাধারণ জনগণের ওপর বৈষম্য কমানোর চেষ্টা করা, সেটা বাড়ানো নয়!