1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মাথাপিছু আয় বনাম জীবনযাত্রার ব্যয়

১২ নভেম্বর ২০২১

বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে৷ করোনায় বেড়েছে দারিদ্র্য৷ আবার বাড়ছে মাথাপিছু আয়৷ এই পরস্পর বিপরীত অবস্থার ব্যাখ্যা কী?

https://p.dw.com/p/42sY6
ছবি: DW/H.U.R. Swapan

সর্বশেষ ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানোর প্রতিক্রিয়ায় বাসের ভাড়া ইচ্ছে মত বাড়ানোয় দেশজুড়ে তোলাপাড় চলছে৷ যদিও বিআরটিএ বাড়তি ভাড়ায় নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করছে৷ তবে তা কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে আছে সংশয়৷ কারণ অতীতে বাস মালিকদের নিয়ন্ত্রণ করা গেছে তার কোনো নজির নেই৷ আর তেলে চলা বাসের ভাড়া বাড়ানোর কথা বলা হলেও গ্যাসে চলা বাসের ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন মালিকরা৷

অর্থনীতিবিদ এবং বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন এর একটি চেইন রিঅ্যাকশন আছে৷ তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের যাতায়াত ভাড়া বেড়ে গেল৷ বেড়ে গেল পণ্য পরিবহন খরচ৷ ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে৷ বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের দাম খুব দ্রুতই বাড়ছে৷ কৃষিদাম পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে৷ ফলে কৃষিপণ্যের দামও বাড়বে৷ এখানে দুই ধরনের প্রভাব পড়ছে৷ উৎপাদন এবং পরিবহন-দুই ধরনের খরচই বাড়ছে৷ অন্য শিল্প উৎপাদনের খরচও বাড়ছে৷ আর যেসব পণ্যের ওপর সরাসরি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব নাই তার দামও বাড়বে৷ কারণ যিনি ভোক্তা তাদেরই একটি অংশ বিক্রেতা ও উৎপাদনকারী৷ ফলে দাম বাড়ছে সবকিছুরই৷

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসেবে ২০২০ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ৷ ২০১৯ সালে বেড়েছে ৬.৫০ শতাংশ আর ২০১৮ সালে বেড়েছে ৬ শতাংশ৷ ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এই সময়ে৷ তারা মনে করছে চলতি বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার হার অতীতের সব হিসেব ছাড়িয়ে যাবে৷

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবে গত এক বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ, আটা-ময়দা ২৯ শতাংশ, সয়াবিন-পাম অয়েলের দাম ৫৪ শতাংশ, মসুর ডাল ১৭ শতাংশ, মুরগির দাম ২৪ শতাংশ, চিনির দাম ২৬ শতাংশ বেড়েছে৷ এভাবে ভোগ্যপণ্যসহ প্রতিটি পণ্যের দামই কম বেশি বেড়েছে৷ আর বাংলাদেশ ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিকস (বিবিএস) বলছে, গত বছরে মার্চে ২৭৭ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা কেনা যেত এই বছরের মার্চে তা কিনতে লেগেছে ২৯২ টাকা৷ অর্থাৎ ১৫ টাকা বেশি খরচ করতে হচ্ছে৷ শতকরা হিসেবে সেটা প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ বেশি৷

বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে এখন দুই হাজার ৫৫৪ ডলার হয়েছে৷ অন্য দিকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিপিআরসি সর্বশেষ গবেষণা বলেছে, তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন৷ গত মার্চে এই সংখ্যা ছিলো দুই কোটি ৪৫ লাখ৷ গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন৷

এই বিপরীত চিত্র কেন? অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হিসাব একটি গড় হিসাব৷ এটা ঠিক যে মোট উৎপাদন বেড়েছে৷ মোট জাতীয় সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে৷ জাতীয় আয় বেড়েছে৷ কিন্তু সেটা কিছু মানুষের, সবার নয়৷ ফলে সবার জীবনে এর প্রভাব নেই৷’’

Infografik Lebensmittelkosten BN

বাংলাদেশে এখন কোটিপতি ব্যাংক গ্রাহকের সংখ্যা এক লাখ৷ করোনার মধ্যেও গত এক বছরে কোটিপতি ব্যাংক গ্রাহক বেড়েছে ১৪ হাজার৷ ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘ওই কোটিপতিদের আয় বেড়েছে৷ ২০ লাখ সরকারি কর্মচারীর আয় বেড়েছে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি৷ বরং অনেকে চাকরি হারিয়েছেন৷ অনেকে কাজ ও ব্যবসা হারিয়েছেন৷’’

আর সাধারণ মানুষের আয় বাড়লেও তা খেয়ে ফেলেছে মূল্যস্ফীতি৷ এখন মূল্যস্ফীতির হার ছয় ভাগ বলে জানান সিপিডির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম৷

বাংলাদেশে এই যে সব কিছুর দাম বাড়ছে তা কতটা যৌক্তিক? বাংলাদেশে প্রতিবছর দাম বাড়ার এই প্রতিযোগিতা শুরু হয় প্রধানত পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল, জ্বালানি তেল অথবা গ্যাস-বিদ্যুতকে ঘিরে৷ প্রয়োজনীয় পেঁয়াজের প্রায় ৮০ ভাগই বাংলাদেশ নিজে উৎপাদন করে৷ বাকি পেঁয়াজ প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করা হয়৷ আর এই আমদানি সংকট শুরু হলেই দাম বাড়তে থাকে৷ যার প্রভাব শুরু হয় সব ভোগ্য পণ্যে৷ ভোজ্য তেলেও বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর৷ তবে এই তেল আমদানি পাঁচটি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে৷ আর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর জন্য বলা হয় আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয়ের কথা৷

জাতীয় আয় বেড়েছে, কিন্তু সেটা কিছু মানুষের, সবার নয়: ড. নাজনীন আহমেদ

কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখানে কাজ করছে সিন্ডিকেট ও সরকারের ভুল নীতি৷ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে এখানে বিপিসি কমায় না৷ কিন্তু বাড়লে বাড়ায়৷ গত এক বছরে এই করে বিপিসি পাঁচ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে৷ অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা ক্ষমতাবান হওয়ায় তাদের সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না বলে জানান ক্যাবের সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন৷ তারা এখন সংসদ সদস্য,মন্ত্রী৷ ফলে তারাই সিদ্ধান্ত নেন৷ যা সাধারণ মানুষের পক্ষে না গিয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষে যায়৷ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি বাজার মনিটরিং টিম, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন কিছুই কাজে আসছে না৷ বাস্তবে এখানে প্রতিযোগিতামূলক কোনো বাজার নেই৷ আছে সিন্ডিকেট৷ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে পরিবহন মালিকদেরও একটি বড় অংশ মন্ত্রী, সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য অথবা প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা৷ তারা নামে বেনামে পরিবহন ব্যবসা করছেন৷ ফলে তাদের সীমাহীন ঔদ্ধত্য৷

পরিবহণ মালিকরা ফায়দা লুটেছে: এস এম নাজের হোসেন

সুশানের জন্য নাগরিকের (সুজন) হিসেবে চলতি একাদশ সংসদে ৬১.৭ শতংশ সংসদ সদস্যই ব্যবসায়ী৷

প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা আইনের মধ্যে থেকে কাজ করি৷ যদি আমরা প্রমাণ পাই বাজার নিয়ন্ত্রণে কোনো সিন্ডিকেট কাজ করছে৷ বাজার ম্যানিপ্যুলেট করছে তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি৷ তবে সেটা হতে হবে প্রমাণ সাপেক্ষে৷’’

উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর মনে করেন, সাধারণ মানুষকে এই অবস্থা থেকে বের করে আনতে হলে সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে তুলতে হবে৷ এখন যে বেষ্টনি আছে আছে তা সব মানুষের জন্য না৷ এটা দলীয় রাজনীতি প্রভাবিত বলেও অভিযোগ আছে৷ তিনি বলেন, ‘‘মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিশ্বব্যাংক প্রভাবিত হিসেব দিয়ে মানুষের প্রকৃত অবস্থা বুঝা যাবে না৷ প্রকৃত অর্থেই সবার আয় বাড়তে হবে৷ কর্মসংস্থানের উদ্যোগ দরকার৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য