জাকির নায়েক কি জঙ্গিবাদের মদতদাতা?
৮ জুলাই ২০১৬গত কয়েকদিন ধরে আবার সারা বিশ্বেই আলোচনা-সমালোচনায় আছেন ভারতীয় ইসলামি চিন্তাবিদ ড. জাকির নায়েক৷ সর্বশেষ খবর, ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকার তাঁর বিষয়ে তদন্ত শুরুর নির্দেশ দিয়েছে পুলিশকে৷ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মুম্বইয়ে জাকির নায়েকের ‘ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন'-এর অফিসের বাইরে ইতিমধ্যে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে৷ ভারতের এনডিটিভি এবং হিন্দুস্থান টাইমস জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের দাবি পূরণ করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে মহারাষ্ট্র সরকার৷
গত ১ জুলাই গুলশানের রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর জাকির নায়েকের নাম নতুন করে আলোচিত হতে থাকে বাংলাদেশে৷ নিহত জঙ্গিদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিয়মিত জাকির নায়েকের ‘উগ্র' বক্তব্য শেয়ার করতেন – এ বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরই নতুন করে শুরু হয় জাকির নায়েককে নিয়ে বিতর্ক৷
ড. জাকির নায়েককে নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়৷ ভারতের মহারাষ্ট্রেই জন্ম নেয়া এই ইসলাম বিষয়ক বক্তা আগে নিষিদ্ধও হয়েছেন৷
গত বছর উসকানিমূলক কথাবার্তা বলার অভিযোগে ভারতের কর্নাটকা রাজ্যে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়৷ শুধু তাকেই নয়, ভারতের মৌলবাদী হিন্দুদের দল আরএসএস-এর নেতা প্রবীন টোগারিয়াকেও তখন নিষিদ্ধ করেছিল কর্ণাটকা সরকার৷
২০১০ সালে ব্রিটেনও জাকির নায়েককে নিষিদ্ধ করে৷ এর তিন বছর পর বিবিসি-তে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়৷ সেখানে বলা হয়, জাকির নায়েকের বক্তব্যে অনেক ‘অগ্রহণযোগ্য' উপাদান থাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁকে নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু তারপরও ব্রিটেনের লাইব্রেরিতে তাঁর বই রয়েছে৷ প্রতিবেদনে আরো দাবি করা হয়, লন্ডনের পাবলিক লাইব্রেরিতে জাকির নায়েকের অন্তত এমন তিনটি বই রয়েছে, যেগুলোতে তিনি জঙ্গিবাদ, নারী এবং ইহুদিদের বিষয়ে চরম আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন৷ প্রতিবেদক এড ডেভি জানান, উর্দুতে লেখা একটি বইয়ে জাকির নায়েক বলেছেন, তিনি ‘মৌলবাদী হতে পেরে গর্বিত'৷ প্রতিবেদকের আরো দাবি ছিল, জাকির নায়েক বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক মুসলমানেরই জঙ্গি হওয়া উচিত৷''
ব্রিটেন ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এবং মালয়েশিয়াতেও ড. জাকির নায়েককে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷
তবে ড. জাকির নায়েক সবসময়ই উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া এবং তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস অথবা অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠনকে সমর্থন দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন৷
কিন্তু গুলশান ট্র্যাজেডির পর আবার উঠেছে সেই প্রশ্ন৷ ড. জাকির নায়েক কি সত্যিই আইএস-কে সমর্থন করেন? আইএস সম্পর্কে তাঁর কী বক্তব্য?
এ নিয়ে সংশয় বা সন্দেহের অবকাশ জাকির নায়েকই রাখেননি৷ এক অনুষ্ঠানে আইএস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে আইএস-এর অন্য নাম আইসিস-এর পূর্ণাঙ্গ রূপ ‘ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া'কে বিকৃত করে ড. জাকির নায়েক বলেন, ‘‘আমি মনে করি, তারা আসলে অ্যান্টিইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া৷'' সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত শ্রোতাদের কেউ কেউ হাততালি শুরু করেন৷
তখাকথিত ইসলামিক স্টেটকে ‘অ্যান্টিইসলামিক', অর্থাৎ ইসলামবিরোধী বলার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে জাকির নায়েক বলেন, ‘‘আমি এমন মনে করি, কারণ, ইসলামপন্থি কোনো ব্যক্তি কখনোই কোনো নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে পারেনা৷''
পবিত্র কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘‘কোরআনে বলা আছে, যদি কেউ কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করে, তাহলে নিহত ব্যক্তি মুসলিম-অমুসলিম যা-ই হোন না কেন, সেই হত্যা পুরো মানবতাকেই হত্যার শামিল৷ একইভাবে কেউ যদি একজন মানুষকে রক্ষা করে, তাহলে সেটাও পুরো মানবতাকেই রক্ষা করার মতো৷এখন এ সব লোক, যারা নিজেদের ‘আইএস' বলে দাবি করে, তারা নিরপরাধ মানুষকেই তো হত্যা করছে৷ নিরপরাধ অমুসলিমদের হত্যা করার কথাও কোরআনে বলা নেই৷ তাই আমার মতে, তারা (আইসিস বা আইএসআইএস বা আইএস) মুসলমানই হতে পারেনা৷ সে-ই মুসলমান, যে কিনা সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে৷ কোনো মুসলমান কখনোই কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করবেনা৷ তাই আমার মতে, তারা (আইএস) অ্যান্টিইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া৷''
সুতরাং, আইএস-এর বিষয়ে ড. জাকির নায়েকের বক্তব্য মোটামুটি স্পষ্ট৷ তিনি মনে করেন, আইএস নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে বলে তারা মুসলমানই নয়, তারা বরং ইসলামবিরোধী৷
কিন্তু এই বক্তব্যই কি তাঁর জঙ্গিবাদবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করে?
ড. জাকির নায়েক জঙ্গিবাদবিরোধী কিনা সে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অন্তত আরেকটি ভিডিও সবারই দেখা দরকার৷ এই ভিডিওটি ২০০৬ সালের৷ তখন আরেক অনুষ্ঠানে আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন এক তরুণ৷ জবাবে জাকির নায়েক কিন্তু লাদেনকে সমর্থনই করেছেন৷
নিচের ইউটিউব ভিডিওতেই রয়েছে লাদেন সম্পর্কে তাঁর সম্পূর্ণ বক্তব্য৷ সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘একজন মুসলমান প্রশ্ন করেছেন, ওসামা বিন লাদেন যা করছেন, ঠিক করছেন কিনা৷ আপনি কি নিজে যাচাই করে দেখেছেন? নাইজেরিয়ায় বোমা বিস্ফোরণ৷ কে করেছে? ওসামা বিন লাদেন৷ হেডলাইন৷ তিনি করেছেন কিনা আমরা তা জানি না৷ তবে আমার মতামত জানতে চাইলে বলবো, যদি তিনি সত্যের পক্ষে থেকে থাকেন, তিনি যদি ইসলামের শত্রুর সঙ্গে লড়াই করেন, আমি তাঁর পক্ষে৷''
সেই অনুষ্ঠানে ড. জাকির নায়েক একটা কথাই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে লাদেন আদৌ খারাপ কোনো কাজ করছেন কিনা তা তিনি জানেন না৷
এমন অবস্থান থেকেই তিনি বলেন, ‘‘আমি জানিনা তিনি (লাদেন) কী করছেন৷ আমি তাঁর সংস্পর্শে নেই৷ ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁকে চিনি না৷ আমি শুধু খবরের কাগজ পড়ি৷ তিনি যদি সন্ত্রাসীদের সন্ত্রস্ত করেন, তিনি যদি সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী অ্যামেরিকাকে সন্ত্রস্ত করে থাকেন, আমি তার পক্ষে আছি৷ প্রত্যেক মুসলমানেরই সন্ত্রাসী হওয়া উচিত৷ ব্যাপারটা হলো, তিনি (লাদেন) যদি সন্ত্রাসীদের মনে ত্রাস ছড়িয়ে থাকেন, তিনি তাহলে ইসলামই অনুসরণ করছেন৷ আসলে তিনি তা করছেন কিনা, তা আমি জানি না৷''
ইসলামি চিন্তাবিদ হলেও নিজের বক্তব্যে ড. জাকির নায়েক কিন্তু বলেছেন, ওসামা বিন লাদেন কী করেছেন তা তিনি জানেন না৷ তিনি আরো বলেছেন, লাদেন যদি সন্ত্রাসীদের মনে ত্রাস ছড়িয়ে থাকেন তাহলে তিনি তার পক্ষে আছেন৷ প্রশ্ন হলো, নিরীহ মানুষ হত্যা করে বলে আইএস-কে ‘ইসলামবিরোধী' বললেও, লাদেন সম্পর্কে জাকির নায়েকের এমন বক্তব্য জঙ্গিবাদকে উসকে দেয়ার মতো কিনা৷
আপনার কী মনে হয়?