জার্মানিতে গণিকাবৃত্তি একটি ‘শিল্প'
২৪ জানুয়ারি ২০১৭শুধু জার্মানি কেন, ইউরোপ জুড়ে গণিকাবৃত্তি ব্যাপক ও অনেক ক্ষেত্রেই দৃষ্টিগোচর, তা সে প্যারিসের বোয়া দ্য বোলোনিয়েতেই হোক আর আমস্টারডামের গ্রাখটেনের ধারেই হোক কিংবা হামবুর্গের রিপারবানেই হোক৷
অপরদিকে গণিকাবৃত্তির ভালোমন্দ নিয়ে নৈতিক বিতর্ক চিরকাল চলেছে ও চলবে৷ আসল প্রশ্ন হলো, সমাজ ও সরকার গণিকাবৃত্তির ক্ষেত্রে কি ব্যবস্থা নেবে৷ সুইডেনে ১৯৯৯ সালে আইন করা হয় যে, যৌনসেবা কেনাটা অপরাধ কিন্তু বেচাটা অপরাধ নয় – অর্থাৎ গণিকা স্বয়ং কোনো অপরাধ করছেন না, অপরাধ করছে তার খদ্দের! জার্মানির প্রখ্যাত নারীবাদি অ্যালিস শোয়ারৎসার জার্মানিতেও এ ধরনের একটি আইন চালু করতে চান৷ জার্মানিতে ২০০৯ সালে আর ২০১৪ সালে দু-দু'বার শোনা গেছে যে, গণিকার কাছ থেকে যৌনসেবা নেওয়ার জন্য পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বিধান করে আইন প্রণয়ন করা হবে – কিন্তু সে পরিকল্পনা আজও বাস্তবায়িত হয়নি৷ অপরদিকে জার্মানির সুপরিচিত গণিকা সংগঠন ‘হাইড্রা'-র মতো বহু গোষ্ঠী এ ধরনের কড়াকড়ির বিরুদ্ধে৷
মোট কথা, যৌনশিল্প বা যৌনকর্মীরা বহুদিন হলো ট্যাবু জোনের ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন৷ যৌনকর্মীরা একটি পরিষেবা দেন, গণিকালয়ের মালিকরা এক ধরনের শিল্পপতি, যৌনসেবার গ্রাহকরা অন্য যে কোনো পণ্যের মতো – শুধু গ্রাহকই৷ এখন দেখতে হবে যাতে এই ‘শিল্পে' শোষণ বা (মানুষ পাচারের মতো) মানবাধিকার ভঙ্গের ঘটনা না ঘটে; আইন-শৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের কোনো হানি না হয়৷
ইতিহাস যা বলে
পশ্চিম জার্মানিতে গণিকাদের নাম লেখানো আর বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যজনিত পরীক্ষার নিয়ম গোড়া থেকেই ছিল৷ বাভেরিয়ায় শুধু এসটিডি বা সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ, অর্থাৎ সংক্রামক যৌন রোগই নয়, ১৯৮৭ সাল থেকে নিয়মিত এইচআইভি টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়৷ কিন্তু বহু যৌনকর্মী নাম রেজিস্ট্রি বা স্বাস্থ্য পরীক্ষা, দু'টোর কোনোটাই করাননি৷ তবে আশির দশকের শেষে এইডস ভীতির ফলে যৌন ব্যবসায়ে কিছুটা ভাটা পড়ে বৈকি – এমনকি হামবুর্গের প্রখ্যাত ‘ইরোস সেন্টার' বন্ধ হয়ে যায়৷
২০০১ সাল অবধি ‘গণিকাবৃত্তির প্রবর্ধন' জার্মানিতে অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো৷ ফলে গণিকালয়ের মালিকরা সারাক্ষণ একটা আইনগত ঝুঁকির মুখে থাকতেন৷ অধিকাংশ গণিকালয় চালানো হতো বার বা পানশালা হিসেবে; সাথে থাকত ঘণ্টায় ভাড়ার কামরা৷ কিছু কিছু পৌর প্রশাসন গণিকাদের রাস্তায় খদ্দের খোঁজা রোধ করার জন্য বেশ কয়েক তলা উঁচু বাড়িও তৈরি করে দিয়েছিলেন, যেখানে গণিকারা বিনা দালালে ঘর ভাড়া করে গ্রাহক নিতে পারতেন৷ এই সব ‘গণিকাদের ডর্মিটরি' আজ ইরোস সেন্টারে পরিণত হয়েছে৷
গণিকাবৃত্তি আর ‘নৈতিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ' নয়
২০০২ সালের গণিকাবৃত্তি আইনের আগে গণিকাবৃত্তিকে ‘নৈতিক শৃঙ্খলার বিরোধী' বলে গণ্য করা হতো, যার নানা আইনগত ফলশ্রুতি ছিল৷ নীতিবিগর্হিত চুক্তির কোনো বৈধতা নেই, কাজেই গণিকারা বকেয়া পারিশ্রমিকের জন্য মামলা করতে পারতেন না; তাদের ঘর বা ফ্ল্যাটভাড়ার চুক্তির কোনো কার্যকরিতা থাকত না; সেখানে গণিকাবৃত্তি ঘটলে, বার কিংবা হোটেলের লাইসেন্স বাতিল করা যেত৷
যৌনকর্মীদের বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশন বা যৌন রোগ পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয় ২০০১ সালে৷ ২০০২ সালে গণিকাদের নিয়মমাফিক ওয়ার্ক কনট্র্যাক্ট বা কাজের চুক্তির ব্যবস্থা করা হয় – যদিও দেখা যায় যে, যৌনকর্মীরা নাম লিখিয়ে নথিভুক্ত হতে বিশেষ আগ্রহী নন৷ অপরদিকে ২০০০ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে ইউক্রেন ইত্যাদি দেশের জার্মান কনসুলেটগুলি তাদের ভিসার নিয়মাবলী আরো শিথিল করার ফলে মানুষ পাচার বাড়ে ও বহু যৌনকর্মী বিদেশ থেকে জার্মানিতে আসেন৷ জার্মানিতে মোট যৌনকর্মীর সংখ্যা চার লাখের কাছাকাছি, বলে ধরা হয়৷ তাদের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই নাকি মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা বিদেশি৷
সুসংগঠিত জার্মানি
মানুষের যৌন প্রয়োজনকে স্বাভাবিক ও বুনিয়াদি প্রয়োজন হিসেবে মেনে নিলে – ও তার সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়া যুক্ত হলে, ফলাফলটা মাঝেমধ্যে চমকপ্রদ হয়৷ যেমন বন শহরে একটি বিশেষ রাস্তায় পথ-গণিকাবৃত্তির জন্য পার্কিং মিটারের মতো মিটার লাগানো আছে৷ তথাকথিত ‘স্ট্রিটওয়াকার'-রা সেখানে কয়েন ফেলে সারারাতের জন্য টিকিট নিতে পারেন ও তাদের যৌনসেবার গ্রাহক সংগ্রহ করতে পারেন৷
অপরদিকে বিভিন্ন এজেন্সি বা সংস্থা যৌনসেবার প্রবীণ বা প্রতিবন্ধী গ্রাহকদের সঙ্গে যৌনকর্মীদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়৷ অতীতে কোলোনের একটি সুবৃহৎ গণিকালয় ঘোষণা করেছিল যে, ৬৬ বছরের বেশি বয়সের প্রবীণ নাগরিকরা দুপুরের দিকে একটি বিশেষ ডিসকাউন্ট বা ছাড় পাবেন৷
বন্ধু, কেমন লাগলো অরুণ শঙ্কর চৌধুরীর ব্লগপোস্ট? লিখুন নীচের ঘরে৷