নির্বাচনি প্রচারের খরচে জার্মানিতে কোনো উর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া নেই৷ কোনো দল বেশি খরচ করে, কেউ কম, যে যার ‘সামর্থ্য অনুযায়ী’৷ কিন্তু তবুও বিশ্বের বহু দেশের তুলনায় জার্মানিতে নির্বাচন অনেকটাই সস্তা৷
২০১৯ সালে ভারতের নির্বাচনি খরচ ছাপিয়ে গিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে৷ ২০২৪ সালে আসন্ন ভারতের লোকসভা নির্বাচন আবার নজির গড়বে বিশ্বের সবচেয়ে খরচসাপেক্ষ নির্বাচন হিসাবে৷ বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে এই লোকসভা নির্বাচনের দাম৷
বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠছে, নির্বাচনি খরচের সীমা বেঁধে দেওয়া হোক, নাহলে জনগণের পকেট থেকে আসতেই থাকবে টাকা৷ জার্মানিতে এমন কোনো দাবির অস্তিত্ব নেই, কারণ বিশ্বের তাবড় গণতন্ত্রের নির্বাচনি খরচের পাশে জার্মানির নির্বাচনি খরচ বেশ অনেকটা কম৷
এতে জার্মান সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির আন্তঃসম্পর্ক আসলে কেমন, তা কিছুটা আঁচ করা যায়৷
যেভাবে টাকা পাচ্ছে জার্মানির দলগুলি
জার্মানিতে রাজনৈতিক দলের খরচের সাথে নির্বাচনি প্রচারের খরচকে আলাদাভাবে হিসাব করার চল তেমন নেই, কারণ জার্মানদের মতে, এটাই স্বাভাবিক যে একটি রাজনৈতিক দল তার সাধ্যের মধ্যে থেকেই প্রচারের কাজ করবে৷
ফলে নির্বাচনের খরচও ধরা থাকে রাজনৈতিক দলগুলির বার্ষিক বাজেটে৷
জার্মানিতে রাজনৈতিক দলের টাকা আসে মূলত পাঁচটি উৎস থেকে৷ সদস্য পদের জন্য চাঁদা, নির্বাচিত সদস্যদের চাঁদা, জনসাধারণের অনুদান, রাষ্ট্রের থেকে পাওয়া সাহায্য ও অন্যান্য আয়, যেমন স্পনসর বা শেয়ার বা অন্যান্য সম্পত্তি৷
কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা এককভাবে যদি ৫০ হাজার ইউরোর বেশি অর্থ কোনো দলকে দেন, তাহলে সেই তথ্য জানাতে হবে জার্মান সংসদ বুন্ডেসটাগকে৷ বুন্ডেসটাগের দায়িত্ব, এমন সকল তথ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা৷ জার্মানির এই ধারা থেকে শিক্ষা নিতে পারে ভারতের নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক চাঁদার ব্যবস্থা, যেখানে স্বচ্ছতার জন্য বর্তমানে সচেষ্ট রয়েছে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট৷
কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা চাইলে যথেচ্ছ অর্থ রাজনৈতিক দলকে দান করতে পারলেও পরিসংখ্যান বলছে, জার্মানিতে রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের খুব ছোট অংশই আসে ব্যক্তিগত চাঁদা থেকে৷ ২০২১ সালে এক সফটওয়্যার সংস্থা গ্রিন পার্টিকে এক মিলিয়ন ইউরো দান করে৷ এটিই এখন পর্যন্ত জার্মান রাজনীতিতে সর্বোচ্চ চাঁদা৷
রাষ্ট্র ও রাজনীতি
রাষ্ট্রের তরফে কোন দল কত অর্থ সাহায্য পাবে, তাও ঠিক করে দেওয়া আছে জার্মান আইনে৷ প্রতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি, দেশের পার্টাইয়েনগেজেটৎস বা দলীয় আইন অনুযায়ী, এই সিদ্ধান্ত নেন সংসদ বা বুন্ডেসটাগের প্রেসিডেন্ট৷
শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র কোন দলকে কতটা সাহায্য করবে, তা ঠিক করা হবে রাজ্য, জাতীয় ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন স্তরের নির্বাচনে এই দলগুলির ফলাফল অনুযায়ী৷
রাজ্যস্তরে মোট ভোটের এক শতাংশ ভোট পেলেই রাষ্ট্রীয় অর্থ সাহায্য পেতে পারে একটি দল৷ জাতীয় বা ইইউ স্তরে শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ ভোট পেলেও এই নিয়ম প্রযোজ্য৷
প্রথম ৪০ লাখ ভোটের জন্য ভোটপিছু এক দশমিক শূন্য ছয় (১.০৬ ইউরো) দেয় জার্মান রাষ্ট্র৷ তারপর, আরো যত ভোট পাবে দলগুলি, সেই ভোটপিছু ৮৭ সেন্ট পাবে তারা৷
এছাড়া, সদস্যপদের জন্য সংগৃহীত প্রতি ইউরোপ্রতি আরো ৪৫ সেন্ট পায় দলগুলি রাষ্ট্রের কাছ থেকে৷
কীসে খরচ হয় এই অর্থ?
২০১৭ সালের নির্বাচনে জার্মানির রাজনৈতিক দলগুলি খরচ করে ৯.২ কোটি ইউরো, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের মতো বড় নির্বাচনের দেশগুলির তুলনায় অনেকটাই কম৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের ভোটাররা জানেন, ভোট কাছে আসা মানেই মাসের পর মাস ধরে ফোন, ইমেল বা মেসেজে রাজনৈতিক প্রচারের ছড়াছড়ি৷ অনেক সময় একটা ফোন কাটতে না কাটতেই দ্বিতীয় ফোন চলে আসে৷
এই রকমের বিস্তৃত প্রচারের জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তা জার্মান রাজনীতির জন্য অনেকটাই অপ্রয়োজনীয় ও কিছু ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিতও৷
স্থানীয় আইন অনুযায়ী, নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগেই প্রচারের পোস্টার বা বড় হোর্ডিং লাগাতে পারে রাজনৈতিক দলগুলি৷ এছাড়া, রেডিও বা টেলিভিশনে ঠিক কত সময় ধরে প্রচার করা যাবে, তাও বেঁধে দেওয়া হয় রাষ্ট্রের তরফে৷ নির্বাচনের এক মাস আগে, আরো কমানো হয় টেলিভিশন ও রেডিওতে প্রচারের সময়৷
ফলে, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে, ততো কমে টাকা খরচ করার সুযোগ৷
কিন্তু জার্মান মডেলের রয়েছে বহু সমালোচনাও৷
জার্মানিতে রাষ্ট্র আইনসম্মতভাবেই কোনো রাজনৈতিক দলকে টাকা দিতে পারে, ভারত-বাংলাদেশে তা হয় না৷ অন্তত খাতায়-কলমে তো নয়ই৷ রাষ্ট্র যখন দলকে টাকা দেয় তখন তা কী বার্তা দেয়? এই প্রশ্ন সাম্প্রতিক সময়ে বহু জার্মানদের ভাবাচ্ছে৷ তাদের প্রশ্ন, তবে কি জার্মান রাষ্ট্রের চোখে গণতন্ত্রপন্থি এসপিডি, পরিবেশবান্ধব গ্রিন পার্টি ও নব্য নাৎসি দল এএফডি, সবাই এক?
জার্মানির বিশেষ ইতিহাসের কি বিবেচিত হবেনা যখন জনগণের টাকা এমন দলের প্রচারে খরচ হয়, যাদের বিরুদ্ধে জার্মান সংবিধান বিরোধিতারও অভিযোগ রয়েছে?
২০২৫ সালের জার্মান নির্বাচনের জন্য এখনও বেশ অনেকটাই সময় হাতে রয়েছে৷ দেড় বছর আগে থেকে রাজনৈতিক প্রচার চালানো জার্মানিতে চলে না, তবে সেই নির্বাচনের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে৷