1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে বাজারে

১২ আগস্ট ২০২২

ঢাকার মগবাজারে থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী মহিন উদ্দিন৷ পাড়ার মুদি দোকানে ডিম কিনতে গিয়ে যেন আকাশ থেকে পড়লেন! কদিন আগে এক ডজন ডিম কিনেছিলেন ১২৫ টাকা দিয়ে৷ বৃহস্পতিবার সকালে একই দোকানে সমপরিমাণ ডিমের জন্য দিতে হলো ১৪০ টাকা৷

https://p.dw.com/p/4FSU0
দেশের মূল্যস্ফীতি অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের চেয়ে কম থাকলেও এখন তা ৯ বা ১০ শতাংশে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে৷
দেশের মূল্যস্ফীতি অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের চেয়ে কম থাকলেও এখন তা ৯ বা ১০ শতাংশে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে৷ছবি: Ahmed Salahuddin/imago images/NurPhoto

এভাবে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম তর তর করে বাড়ছে প্রতিদিন৷ ৫ আগস্ট রাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার গতি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে৷

খুব বিরক্ত মহিন উদ্দিন বললেন, ‘‘এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? চাল-ডাল সব কিনছি বেশি টাকা দিয়ে৷ গাড়ি ভাড়াও বেড়ে গেছে৷ বেতন তো বাড়েনি৷ কীভাবে বাঁচব জানি না৷''

তার মতো দশা আরও অনেকের৷ তাদের একজন হালিমা আক্তার৷ এই পোশাক শ্রমিককে দেখা গেল ভ্যান থেকে শাক কিনছেন৷ তাও আবার তিন রকমের৷

কারণ জানতে চাইলেই তিনি বলেন, ‘‘শাক ছাড়া আর কুনু সবজিতে হাত দেওন যায় না৷ আর কিতা করতাম৷ শাকই ভালা৷ দামটা একটু অইলেও কম আছে৷''

করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাত থেকে বিশ্ব যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, ঠিক তখনও বিশ্ব জুড়ে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়ছিল অনেক ‍উন্নত দেশ৷ এর মধ্যে চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ব পড়ে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে৷ জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, সার সংগ্রহ করতে দেশে দেশে রিজার্ভ পড়েছে চাপে৷ এর বাইরে নয় বাংলাদেশও৷

বাড়তি আমদানি ব্যয় মেটাতে ছয় মাসেই দেশের রিজার্ভ কমেছে সাত বিলিয়ন ডলারেরও বেশি৷ রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের দারুণ ঊর্ধ্বগতিতেও পরিস্থিতি বাগে আনা যাচ্ছে না৷ ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হতে হতে ঠেকেছে ৯৫ টাকায়৷ খোলাবাজারে দর এর চেয়ে ২৫ টাকা বেশি৷

এর মধ্যে ৫ আগস্ট রাতে আসে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর খবর৷ ডিজেল ও কেরোসিনে লিটারে বাড়ানো হয়েছে ৩৪ টাকা৷ এখন ডিজেল ও কেরোসিন কিনতে ভোক্তাকে দিতে হচ্ছে ১১৪ টাকা করে৷

অন্যদিকে অকটেনে প্রতি লিটারে বাড়ানো হয়েছে ৪৬ টাকা৷ প্রতি লিটার অকটেন বেড়ে হয়েছে ১৩৫ এবং পেট্রোলে ৪৪ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৩০ টাকা লিটার৷ এই হিসাবে ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ আর অকটেন-পেট্রোলে বেড়েছে ৫১ শতাংশ৷

বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়া এমন সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে তুলে ধরে সরকার৷

২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিলের পর গেল বছরের ৩ নভেম্বর দেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করে সরকার৷ ওই সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হয় লিটারে ১৫ টাকা করে৷ তখন পণ্য দুটি কিনতে ভোক্তাকে লিটার প্রতি গুণতে হতো ৮০ টাকা৷

খোলাবাজারে ডলারের দর ১২০ টাকা উঠে যাওয়ার পর অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগের কারণে দরপতন হচ্ছে পুঁজিবাজারে৷ এর মধ্যে জ্বালানির দর বৃদ্ধিজনিত কারণে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পর নতুন করে বাড়ছে পণ্যমূল্য৷

আর্থিক চাপে মানুষ ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে৷ নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা শখ আহ্লাদ বাদ দিয়ে, সন্তানের পেছনে ব্যয় কমিয়ে, এমনকি খাবারের ব্যয় কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন

তেলের বাড়তি দরের কারণে জনভোগান্তি যেমন বেড়েছে তেমনি সরকারকেও পড়তে হয়েছে রাজনৈতিক চাপে৷ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমাগত আক্রমণের মুখে সরকারের দৃশ্যত কোনো শক্তিশালী জবাব নেই৷ এই পরিস্থিতি আগামী জাতীয় নির্বাচনে সরকারকে চাপে ফেলতে পারে-এমন আশঙ্কা করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই৷

এর মধ্যেই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সতর্ক করে দিয়েছেন, তেলের দাম বাড়ানোর কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়বে৷

তেলের দাম বাড়ানোর দুই দিন পরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, বিশ্ববাজারে কমলে দেশেও কমবে তেলের দাম৷

সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য জ্বালানির তেলের এই দাম বৃদ্ধিকে সাময়িক বলা হচ্ছে৷ কারণ এর মধ্যে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়ে দিয়েছেন, তেলের দাম কমাতে দুই মাস সময় লাগতে পারে৷

চলমান বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের কাছে৷ ঋণের শর্ত কী হবে, তা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে না জানালেও ধারণা করা হচ্ছে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা জানাবে তারা৷ এরই মধ্যে সারের দাম কিছুটা বাড়িয়েছে সরকার৷

আইএমএফের ফর্মুলা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দাম নির্ধারণ করতে হবে৷ অর্থাৎ বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম বাড়বে, তখন দেশের ভেতরে সরকার দাম বাড়াবে৷ আবার দাম কমলে সেই অনুপাতে দাম কমাতে হবে৷

এ পদ্ধতি অনুসরণ করে দাম সমন্বয় করা হলে তেলের দাম স্থিতিশীল হবে, একই সঙ্গে এ খাতে যে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি লাগে, তা কমে আসবে৷ আর এ কারণেই জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে এতোটা বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে৷

সরকারের এমন ‘অজনপ্রিয়' সিদ্ধান্ত জনভোগান্তি তৈরি করলেও এটাকে বড় সংকট হিসেবে দেখছেন না পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর৷

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি তেলের দাম বাড়ানোতে জন মানুষের কষ্ট হবে৷ কিন্তু দেশে যে একটা সংকট তৈরি হয়ে যাবে, সেটা আমি মনে করি না৷ সবাই বুঝি, কেন এটা করা হয়েছে৷ জনগণকে সেটা বোঝানো হয়েছে, আরও বোঝাতে হবে৷ বোঝাতে হবে, কেন দরকার ছিল৷ না করলে কী হতো? মূল্যস্ফীতি তাহলে আরও বেড়ে যেত৷ এখন তো একবারের মূল্যস্ফীতি হবে, তখন স্থায়ী মূল্যস্ফীতি তৈরি হতো৷''

এই অর্থনীতিবিদের দাবি, গোটা বিশ্বে দাম বাড়ার কারণে সরকার অনেকটা বাধ্য হয়েই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে৷

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘এটা ধরে রাখা সম্ভব ছিল না৷ সাবসিডির পরিমাণটা এত বেশি৷ অবশ্যই জনজীবনে এটার বিশাল প্রভাব পড়বে এবং অলরেডি পড়ছে৷''

জ্বালানির মধ্যে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ডিজেলের নামটি উচ্চারণ করেছেন আহসান এইচ মনসুর৷ তিনি বলেন, ‘‘ডিজেলের দাম অনেক বেশি বাড়ানো হয়েছে৷ যার কারণে যাতায়াতে ভাড়া বেড়েছে, পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়েছে৷ আমরা মনে করি যে দুই থেকে আড়াই শতাংশ মূল্যস্ফীতি বাড়বে৷ ফলে বড় একটা ধাক্কা সামনে আসছে৷''

দেশের মূল্যস্ফীতিটা অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের চেয়ে কম থাকলেও এখন তা ৯ বা ১০ শতাংশে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন৷

সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক বলতে নারাজ সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান৷

তিনি বলেন, ‘‘মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ সরকারের উচিত হবে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা৷''

নিত্য পণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘তাদের জীবনযাপন আরও দুরুহ হয়ে যাবে৷''

দেশের বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বল দিকটি তুলে ধরে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘‘ডিজেলের দাম বাড়ার ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে৷ মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাবে৷ সব মিলিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে৷''

ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তা সমন্বয় করা উচিত বলেও মত দেন সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো৷

একলাফে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর এই সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলেই মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন৷

তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম কম ছিল তখন বিপিসি অনেক লাভ করেছে৷ এখন বিশ্ববাজারে দামবৃদ্ধির পর বিপিসি সেই লাভের মূল্য সমন্বয় না করে, সাবসিডি না দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক৷''

চতুর্মুখী চাপের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের ইঙ্গিত মিলেছে৷ অন্যদিকে দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা জনগণের সামনে তুলে ধরতে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশও দিয়েছে মন্ত্রিসভা৷

বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘‘জ্বালানি মন্ত্রণালয় বা বিপিসিকে বলা হয়েছে, তারা যাতে ইমিডিয়েটলি জিনিসগুলো ক্ল্যারিফাই করে৷ এগুলো ওনাদের ব্রিফিংয়ে সব ক্লিয়ার করবেন৷ আজকে মূলত তারা পুরো ক্যাবিনেটকে ব্রিফিং করেছেন৷ ক্যাবিনেট কোনো অপিনিয়ন (মতামত) দেয়নি৷''