জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে বাজারে
১২ আগস্ট ২০২২এভাবে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম তর তর করে বাড়ছে প্রতিদিন৷ ৫ আগস্ট রাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার গতি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে৷
খুব বিরক্ত মহিন উদ্দিন বললেন, ‘‘এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? চাল-ডাল সব কিনছি বেশি টাকা দিয়ে৷ গাড়ি ভাড়াও বেড়ে গেছে৷ বেতন তো বাড়েনি৷ কীভাবে বাঁচব জানি না৷''
তার মতো দশা আরও অনেকের৷ তাদের একজন হালিমা আক্তার৷ এই পোশাক শ্রমিককে দেখা গেল ভ্যান থেকে শাক কিনছেন৷ তাও আবার তিন রকমের৷
কারণ জানতে চাইলেই তিনি বলেন, ‘‘শাক ছাড়া আর কুনু সবজিতে হাত দেওন যায় না৷ আর কিতা করতাম৷ শাকই ভালা৷ দামটা একটু অইলেও কম আছে৷''
করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাত থেকে বিশ্ব যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, ঠিক তখনও বিশ্ব জুড়ে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়ছিল অনেক উন্নত দেশ৷ এর মধ্যে চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ব পড়ে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে৷ জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, সার সংগ্রহ করতে দেশে দেশে রিজার্ভ পড়েছে চাপে৷ এর বাইরে নয় বাংলাদেশও৷
বাড়তি আমদানি ব্যয় মেটাতে ছয় মাসেই দেশের রিজার্ভ কমেছে সাত বিলিয়ন ডলারেরও বেশি৷ রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের দারুণ ঊর্ধ্বগতিতেও পরিস্থিতি বাগে আনা যাচ্ছে না৷ ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হতে হতে ঠেকেছে ৯৫ টাকায়৷ খোলাবাজারে দর এর চেয়ে ২৫ টাকা বেশি৷
এর মধ্যে ৫ আগস্ট রাতে আসে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর খবর৷ ডিজেল ও কেরোসিনে লিটারে বাড়ানো হয়েছে ৩৪ টাকা৷ এখন ডিজেল ও কেরোসিন কিনতে ভোক্তাকে দিতে হচ্ছে ১১৪ টাকা করে৷
অন্যদিকে অকটেনে প্রতি লিটারে বাড়ানো হয়েছে ৪৬ টাকা৷ প্রতি লিটার অকটেন বেড়ে হয়েছে ১৩৫ এবং পেট্রোলে ৪৪ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৩০ টাকা লিটার৷ এই হিসাবে ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ আর অকটেন-পেট্রোলে বেড়েছে ৫১ শতাংশ৷
বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়া এমন সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে তুলে ধরে সরকার৷
২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিলের পর গেল বছরের ৩ নভেম্বর দেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করে সরকার৷ ওই সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হয় লিটারে ১৫ টাকা করে৷ তখন পণ্য দুটি কিনতে ভোক্তাকে লিটার প্রতি গুণতে হতো ৮০ টাকা৷
খোলাবাজারে ডলারের দর ১২০ টাকা উঠে যাওয়ার পর অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগের কারণে দরপতন হচ্ছে পুঁজিবাজারে৷ এর মধ্যে জ্বালানির দর বৃদ্ধিজনিত কারণে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পর নতুন করে বাড়ছে পণ্যমূল্য৷
আর্থিক চাপে মানুষ ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে৷ নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা শখ আহ্লাদ বাদ দিয়ে, সন্তানের পেছনে ব্যয় কমিয়ে, এমনকি খাবারের ব্যয় কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন৷
তেলের বাড়তি দরের কারণে জনভোগান্তি যেমন বেড়েছে তেমনি সরকারকেও পড়তে হয়েছে রাজনৈতিক চাপে৷ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমাগত আক্রমণের মুখে সরকারের দৃশ্যত কোনো শক্তিশালী জবাব নেই৷ এই পরিস্থিতি আগামী জাতীয় নির্বাচনে সরকারকে চাপে ফেলতে পারে-এমন আশঙ্কা করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই৷
এর মধ্যেই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সতর্ক করে দিয়েছেন, তেলের দাম বাড়ানোর কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়বে৷
তেলের দাম বাড়ানোর দুই দিন পরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, বিশ্ববাজারে কমলে দেশেও কমবে তেলের দাম৷
সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য জ্বালানির তেলের এই দাম বৃদ্ধিকে সাময়িক বলা হচ্ছে৷ কারণ এর মধ্যে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়ে দিয়েছেন, তেলের দাম কমাতে দুই মাস সময় লাগতে পারে৷
চলমান বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের কাছে৷ ঋণের শর্ত কী হবে, তা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে না জানালেও ধারণা করা হচ্ছে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা জানাবে তারা৷ এরই মধ্যে সারের দাম কিছুটা বাড়িয়েছে সরকার৷
আইএমএফের ফর্মুলা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দাম নির্ধারণ করতে হবে৷ অর্থাৎ বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম বাড়বে, তখন দেশের ভেতরে সরকার দাম বাড়াবে৷ আবার দাম কমলে সেই অনুপাতে দাম কমাতে হবে৷
এ পদ্ধতি অনুসরণ করে দাম সমন্বয় করা হলে তেলের দাম স্থিতিশীল হবে, একই সঙ্গে এ খাতে যে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি লাগে, তা কমে আসবে৷ আর এ কারণেই জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে এতোটা বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে৷
সরকারের এমন ‘অজনপ্রিয়' সিদ্ধান্ত জনভোগান্তি তৈরি করলেও এটাকে বড় সংকট হিসেবে দেখছেন না পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি তেলের দাম বাড়ানোতে জন মানুষের কষ্ট হবে৷ কিন্তু দেশে যে একটা সংকট তৈরি হয়ে যাবে, সেটা আমি মনে করি না৷ সবাই বুঝি, কেন এটা করা হয়েছে৷ জনগণকে সেটা বোঝানো হয়েছে, আরও বোঝাতে হবে৷ বোঝাতে হবে, কেন দরকার ছিল৷ না করলে কী হতো? মূল্যস্ফীতি তাহলে আরও বেড়ে যেত৷ এখন তো একবারের মূল্যস্ফীতি হবে, তখন স্থায়ী মূল্যস্ফীতি তৈরি হতো৷''
এই অর্থনীতিবিদের দাবি, গোটা বিশ্বে দাম বাড়ার কারণে সরকার অনেকটা বাধ্য হয়েই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে৷
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘এটা ধরে রাখা সম্ভব ছিল না৷ সাবসিডির পরিমাণটা এত বেশি৷ অবশ্যই জনজীবনে এটার বিশাল প্রভাব পড়বে এবং অলরেডি পড়ছে৷''
জ্বালানির মধ্যে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ডিজেলের নামটি উচ্চারণ করেছেন আহসান এইচ মনসুর৷ তিনি বলেন, ‘‘ডিজেলের দাম অনেক বেশি বাড়ানো হয়েছে৷ যার কারণে যাতায়াতে ভাড়া বেড়েছে, পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়েছে৷ আমরা মনে করি যে দুই থেকে আড়াই শতাংশ মূল্যস্ফীতি বাড়বে৷ ফলে বড় একটা ধাক্কা সামনে আসছে৷''
দেশের মূল্যস্ফীতিটা অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের চেয়ে কম থাকলেও এখন তা ৯ বা ১০ শতাংশে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন৷
সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক বলতে নারাজ সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান৷
তিনি বলেন, ‘‘মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ সরকারের উচিত হবে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা৷''
নিত্য পণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘তাদের জীবনযাপন আরও দুরুহ হয়ে যাবে৷''
দেশের বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বল দিকটি তুলে ধরে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘‘ডিজেলের দাম বাড়ার ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে৷ মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাবে৷ সব মিলিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে৷''
ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তা সমন্বয় করা উচিত বলেও মত দেন সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো৷
একলাফে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর এই সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলেই মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন৷
তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম কম ছিল তখন বিপিসি অনেক লাভ করেছে৷ এখন বিশ্ববাজারে দামবৃদ্ধির পর বিপিসি সেই লাভের মূল্য সমন্বয় না করে, সাবসিডি না দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক৷''
চতুর্মুখী চাপের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের ইঙ্গিত মিলেছে৷ অন্যদিকে দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা জনগণের সামনে তুলে ধরতে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশও দিয়েছে মন্ত্রিসভা৷
বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘‘জ্বালানি মন্ত্রণালয় বা বিপিসিকে বলা হয়েছে, তারা যাতে ইমিডিয়েটলি জিনিসগুলো ক্ল্যারিফাই করে৷ এগুলো ওনাদের ব্রিফিংয়ে সব ক্লিয়ার করবেন৷ আজকে মূলত তারা পুরো ক্যাবিনেটকে ব্রিফিং করেছেন৷ ক্যাবিনেট কোনো অপিনিয়ন (মতামত) দেয়নি৷''