জয়ের শতকরা হিসেব ৩৮.১০ ভাগ। মানের হিসেবে মোটেও এই ফলাফলকে ভালো কিছু বলার উপায় নেই।
অথচ টি- টোয়েন্টি ক্রিকেটের শুরুর দিকে বেশ জোর গলায় বলা হতো ক্রিকেটের সর্বশেষ এই সংস্করণে বাংলাদেশ ভালো করবে। এই ফরম্যাটের ব্যাটিং বাংলাদেশের ধাতের সঙ্গে বেশ যায়। বাংলাদেশের ব্যাটাররা শটস খেলতে পছন্দ করে। আর টি- টোয়েন্টি মানেই তো শটসের বাহার। ২০০৭ সালে টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অভিষেক আসরে বাংলাদেশ তাদের প্রথম ম্যাচেই শক্তিমান ওয়েস্ট ইন্ডিজকে যখন হারিয়ে দিলো, তখন বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তিটা আরো ধারালো হয়।
কিন্তু আজ দুই দশক পরে পরিসংখ্যান জানাচ্ছে সেই যুক্তি ছিল ভুল এবং মরচে পড়া ধার! অভিষেকে সেই জয়ের পর বাংলাদেশ আর কখনো টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মুলপর্বে বড় কোনো দলকে হারাতে পারেনি। গ্রুপ পর্ব থেকেই প্রতিবার বিদায় নিয়েছে। সামনেই বাড়তে পারেনি। আর এই সময়ের মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দু'বার এই ফরম্যাটের বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছে। যে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বাংলাদেশ টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের যাত্রা শুরু করেছিল।
২০০৭ থেকে ২০২২ পেছনের প্রতিটি বিশ্বকাপের আসরে আমরা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি বাকিদের ‘'রাস উৎসব, অবিরল রংয়ের ধারা। বাংলাদেশের দিকে কেউ ফিরেও চায়নি।''
টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এখন বাকিরা ট্রফি জিততে যায়। আর বাংলাদেশ সেখানে কেবল অংশগ্রহণকারী দল হিসেবে একটা সংখ্যা।
-কেন এমন হলো? আসুন উত্তর মেলাই।
বাস্তবতা হলো টি- টোয়েন্টির জন্য যে হার্ডহিটিং যোগ্যতা, স্কিল, টেম্পারমেন্ট, ইনটেন্ট ও ইমপ্যাক্ট চাই, এই জেনারেশনের বেশিরভাগ ক্রিকেটারের তা নাই।
জেনারেশন বলতে কোন জেনারেশন?
হিসেবটা সহজ করে দেই- সাকিব, মাশরাফি, মাহমুদউল্লাহ এদের জেনারেশনের উদাহরণই আমি দিচ্ছি এখানে। এই জেনারেশনের যে ক্রিকেটীয় যোগ্যতা আছে, তা দিয়ে আপনি ওয়ানডে ক্রিকেটের সাঁকো পার হতে পারবেন। তা-ও আবার মাঝে সাঝে, সবসময় নয়! হ্যাঁ এই তালিকায় একটা ব্যতিক্রম নাম আছে-সাকিব আল হাসান। মুলত টি- টোয়েন্টির জন্য যে ধাত বা ম্যাটেরিয়ালের ক্রিকেটার প্রয়োজন সেই অনুষঙ্গ পেছনের দুই দশকে কেবল ঐ একজনের মধ্যেই দেখা গেছে- সাকিব আল হাসান।
কিন্তু ক্রিকেট তো টিম গেম। এখানে আপনি একের কৃতিত্বে একটা দুটো ম্যাচ জিততে পারেন। কিন্তু ধারাবাহিক সাফল্য পাবেন না। বড়কিছু জিততে পারবেন না। টুর্নামেন্ট তো নয়ই।
উদারহণ চান?
সে তো হাতের কাছেই! সাকিব টি- টোয়েন্টিসহ বিশ্ব ক্রিকেটের নাম্বার ওয়ান খেলোয়াড় হয়েছেন। লম্বা সময় ধরে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের সন্মান জুটেছে তার। কিন্তু বাংলাদেশের সিনিয়র দলের তো দল হিসেবে আজও কোনো বৈশ্বিক ট্রফি জেতা হয়নি। আমরা সেই শুরুর টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে খেলছি, কিন্তু এই ফরমেটের জন্য যেমন স্কিল সেটিংয়ের প্রয়োজন তেমন খেলোয়াড় কই?
এক দুজনের প্রতিভার স্ফুরণ দিয়ে আপনি একক কৃতিত্বের জন্য হাততালি পেতে পারেন। কিন্তু গলায় চ্যাম্পিয়নশিপের মেডেল পরার জন্য পুরো দলকে সত্যিকার অর্থেই চ্যাম্পিয়ন হতে হবে। আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে এগারো জনের বাংলাদেশ সেই সম্মিলিত সংহতির দলে হয়ে শক্তিমান হতে পারেনি আজও।
তাই আমরা এখনো যে কোনো টুর্নামেন্টে কেবল একটি অংশগ্রহণকারী দল হয়ে আছি মাত্র!
যে কোনো বিষয়ে সাফল্য পেতে হলে আপনাকে সেই বিষয় সম্পর্কে আগে সম্যক জ্ঞান, গবেষণা এবং দুরদর্শিতায় দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। তাহলে বদলে যাওয়া সময় ও কৌশলের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়। এই অ্যাডাপ্টেশনের সঙ্গে যে যত দ্রুত নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে দিন শেষে সফল সে-ই।
বাংলাদেশ টি- টোয়েন্টি বাংলাদেশ খেলছে ২০০৬ সাল থেকে। তবে পেছনের এই ১৮ বছরে এই ফরমেটের ক্রিকেটে যে বদল এসেছে সেই বদলের সঙ্গে কি বাংলাদেশ পুরোদুস্তর মানিয়ে নিতে পেরেছে?
উত্তর হলো-পারেনি।
পারেনি বলেই এখনো আমরা টি- টোয়েন্টিতে ছক্কা মারার জন্য ‘মাসলম্যান ব্যাটার' খুঁজি। পারেনি বলেই এখনো আমরা ম্যাচ হারলে অজুহাত খুঁজি। পারেনি বলেই এখনো আমাদের এই ফরম্যাটে কোনো স্পেশালিষ্ট নেই। পারেনি বলেই এখনো আমরা পাওয়ার প্লে ব্যাটিংয়ে মাত্র ৪০/৪৫ রান করলেই তৃপ্তি খুঁজি। পারেনি বলেই এখনো টি- টোয়েন্টিতে আমাদের কারোর ব্যাটিংয়ে দুশো স্ট্রাইকরেট নেই! অথচ টি- টোয়েন্টিতে সাফল্য পেতে হলে এই গুনগুলো হলো আবশ্যিক শর্ত। হারলেই উইকেট, কন্ডিশন, অনুশীলন-এসবকে অজুহাত হিসেবে দাড় না করিয়ে নিজের খেলাকে কিভাবে আরো উন্নত করা যায়, কিভাবে লড়াইয়ে ফিরে আসা যায়; সেই পরিকল্পনার পথে হাঁটা উচিত।
সহজ কথা মাঝারি বা গড়পড়তা মানের চিন্তা ভাবনা; গেলাম, খেললাম, হারলাম কিন্তু টাকা তো কামালাম-এমন ব্র্যাকেটে আটকে থাকলে বাকি জীবন আমরা অন্যকে ট্রফি হাতে উৎসব করতে দেখবো আর নিজেরা সেই প্রতিযোগিতায় কেবল হাততালি দিয়ে সান্ত্বনা খুঁজবো, ‘আরে ভাই অংশগ্রহণই তো বড় কথা!'
যা পরিস্থিতি দাড়িয়েছে তাতে এখন বড় টুর্নামেন্টের আগে যেমন ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তানের নামের পাশে হট ফেভারিট ট্যাগ ঝুলে তখন সেখানে বাংলাদেশের নামটা আলোচনায় এলে পাশে ব্র্যাকেট দিয়ে হয়তো লেখা থাকবে- অংশগ্রহণকারা দল মাত্র!
দুই দশক আগে টি- টোয়েন্টিতে ১৬০/১৭০ রানকে অনেক বড় স্কোর মানা হতো। ওভার প্রতি ৯ রানকেই তখন ভাবা হতো ম্যাচ উইনিং ফর্মূলা। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিতে ও বিবর্তনে টি- টোয়েন্টি ধাঁচ বদলে গেছে। এখন ১২০ বলে ২০০ রানকে একটা স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়। সেই রানও আবার চেইজ হয়ে যায়! টি- টোয়েন্টিতে কোনো ব্যাটারের সেট হওয়ার কোনো সময় নেই। বল নষ্ট করার কোনো উপায় নেই। এখানে একটা ডট বল মানেই পিছিয়ে পড়া। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটাররা প্রতি ম্যাচেই সেট হতে সময় নেন। ডট বলে শুরু করেন। ধরুন যদি শুরুর পাঁচ ব্যাটার সেট হতে গিয়ে প্রথম রান করতেই যদি চারটি করে বল ডট দিলেন। তাহলে ২০ বল ডট। অর্থাৎ তিনের বেশি ওভার ডট! হয়তো বলবেন পরে সেট হয়ে সেই ব্যাটার ধুমধাড়াক্কা খেলে সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে দেবেন। সমস্যা হলো অনেকগুলো ডট বল খেলে সেট হওয়ার পর সেই ব্যাটার যদি তখনই আউট হয়ে যান, সেক্ষেত্রে সমস্যা তো আরো বাড়বে।
হচ্ছেও সেটাই। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সিরিজের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ১২০ বলে তুলেছে মাত্র ১৫৩ রান। ব্যাটাররা ডট বল দিয়েছেন ৪৫টি। ১২০ বলের মধ্যে ৪৫টি ডট বল! এটা শুধু একটা ম্যাচের হিসেব। এমনটা হচ্ছে হরদম প্রায় ম্যাচে। টি- টোয়েন্টিতে প্রথম বল থেকে মারার মতো ব্যাটার আমাদের কই? নেই। আর তাই ডটবলের শূন্যতা পুরুণ ম্যাচে আর হয়ে উঠছে না। এই ডটবলের কারনে তো বাংলাদেশ দলে একজন ব্যাটারকে ‘ডটবাবা' নামে ডাকা শুরু হয়ে গেল!
আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট এখন এমনই কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও লড়াইয়ের ক্ষেত্র যে এখানে বিরাট কোহলি পর্যন্ত স্লো খেললে তাকে সমালোচনা শুনতে হয়। আর আমাদের এখানে লম্বা সময় ধরে ফর্মে নেই, এমন ব্যাটারকেও শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে দলের সঙ্গে রাখা হয়। তাতে বরং লাভ হয় না। উল্টো হারের অভিজ্ঞতা আরো বাড়ে। আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট কখনো কোনো অফফর্মে থাকা ক্রিকেটারকে ফর্মে ফেরানোর জায়গা হতে পারে না। আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে খেলবেন ফর্মে থাকা ক্রিকেটার এবং সেই ফর্মকে আরো ধারালো করে দলকে জেতাবেন-এটাই তো তার কাজ।
সমস্যা হলো ফর্মহীন থাকা সত্ত্বেও ক্রিকেটারকে দলে নেওয়ার যুক্তি হিসেবে যখন নির্বাচক বলেন বিকল্প হিসেবে অন্য আরো যারা আছে তাদের ওপর আস্থা কম তখন বুঝে নিতে হবে আপনার বিকল্প সত্যিকার অর্থেই বিকল!
সেই দায়টা কার? নিশ্চয়ই বিসিবির। কারন খেলোয়াড় তো এনে দিবে তারা। বাকিটা নির্বাচকরা বাছাই করবেন। বিশ্বকাপ আসরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো নবিশ দলের বিরুদ্ধে হারের পর যখন দলের অধিনায়ক দেশে বাজে উইকেটে খেলাকে দোষ দিচ্ছেন তখন সেটা আর অজুহাত নয়, অনেক বড় অভিযোগ! এতোদিন হয়ে গেল আমরা একটা ভালো উইকেট তৈরি করে সেখানে ব্যাটিংয়ের অভ্যাস আজো গড়তে পারলাম না কেন?
২০০৭ সালের প্রথম বিশ্বকাপে যে মানের টি- টোয়েন্টি খেলতো বাংলাদেশ আজ ২০২৪ এসে সেই ধাঁতে, তেজে, কৌশলে, চিন্তায়, আধুনিকতায় এবং সার্বিক পরিকল্পনায় হয়তোবা কিছুটা বদল এসেছে মানছি, কিন্তু সেই সঙ্গে স্পষ্ঠ জানছি এবং দেখছি এই সময়টায় অন্য দেশগুলো এই ক্রিকেট উন্নতির দৌড়ে অনেক অনেক দুর এগিয়ে গেছে। সেই দুরুত্বটা এতোই বেশি হয়ে পড়েছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে অভিষেক হওয়া সবগুলো বড়দল হয় টি- টোয়েন্টি বিশ^কাপ জিতেছে, নয় অন্তত সেমিফাইনালে খেলেছে। আর আমরা এখনো রয়ে গেছি সেই অংশগ্রহণকারি দল হয়েই।
সম্ভবত এবারো তাই!