দেশের প্রশ্নে এক হওয়ার ভিত্তি হোক গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধ
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪হাজারের ওপর মানুষকে হত্যা করেছিল তারা। অধ্যাপক ড. জিন্নাতুল আলম জিন্নাকেও হত্যা করা হতো। কিন্তু দৈব্যক্রমেই বেঁচে যান তিনি।
পুলিশ একাডেমির সঙ্গেই তার বাড়ি। একাত্তরে তিনি ছিলেন অনার্স ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র। থানাপাড়া গণহত্যায় খুব কাছ থেকে প্রিয়জনের মৃত্যু দেখেছেন, লাশ টেনেছেন, শহিদদের রক্তে ভিজেছে নিজের শরীর। সেসব কথা তার বুকের ভেতর জমে আছে কষ্টের মেঘ হয়ে।
জিন্নাতুল আলমের মুখোমুখি হলে তিনি বলেন যেভাবে, "বেলা তখন দুইটা বা আড়াইটা হবে। এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের কমান্ডে পাকিস্তানি আর্মি সারদা পুলিশ একাডেমির ভেতরে ঢোকে। থানাপাড়াসহ আশপাশের মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল একাডেমির ভেতরের চরের মধ্যে। আর্মি দেখে সবাই ছোটাছুটি শুরু করে।ওরা সবাইকে একত্রিত করে প্রথমে। অতঃপর মহিলা ও শিশুদের আলাদা করে বলে, ‘‘তুম ঘার চলে যাও।''
সিপাহিরা অস্ত্র তাক করে চারদিক ঘিরে ফেলে। ওই ক্যাপ্টেন তখন অস্ত্র লোড করছে। আমাকে ওরা ডেকে নেয়। ব্রাশফায়ার করার প্রস্তুতি নিতে থাকে। এটা শুরু করে ওই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন। ২০ বা ২৫ মিনিট নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় সে। মানুষের রক্তে ভেসে যেতে থাকে গোটা চরের মাটি।
সবকিছু ঘটছে চোখের সামনে। চাচাতো ভাই খায়রুল আলম পরাগ ‘আম্মা' বলে একটা চিৎকার দেয়। এরপর আর কোনো সাড়া নেই!'' ‘আমিসহ কয়েকজনকে ওরা প্যারেড গ্রাউন্ডে নিয়ে আসে। সেটি বেশ উঁচুতে। খানিক পরেই সেখান থেকে দেখা গেল চরে স্তূপ করা লাশের ভেতর থেকে অনেকেই পালাচ্ছে।''
‘‘রক্তাক্ত অবস্থায় কেউ ওপরে, কেউবা নদীর দিকে ছুটে যাচ্ছে।'' ‘‘ওই ক্যাপ্টেন তখন চিৎকার দিয়ে বলে, ‘এলএমজি ছোড়ো, এলএমজি ছোড়ো।'
তখন এলএমজি দিয়ে ওরা নৃশংসভাবে মানুষগুলোকে মারে। চরের দিকে আসতেই দেখি চাচা আজিজুল আলমকে। গুলি লেগে তার ভুড়ির অনেকটাই বের হয়ে এসেছে। যন্ত্রণায় তিনি কাতরাচ্ছেন। জ্ঞান তখনও ছিল। প্রতিবাদ করে চাচা তখন ওই ক্যাপ্টেনকে চেচিয়ে বলেন, ‘ইয়ে ক্যায়সা জুলুম হ্যায় ভাই? ইয়ে ক্যায়সা জুলুম হ্যায়? খোদাতালা বরদাসত নেহি করেগা।' কথাগুলো পরপর তিনবার বলেন তিনি।
ওই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন তখন গর্জে উঠে। ‘শুয়োরকা বাচ্চা' বলেই চাচার খুব কাছে গিয়ে কপালের মাঝ বরাবর একটা গুলি করে। তিনি শুধু একবার ‘উ্হ' শব্দটি করেছিলেন, এরপরই উপুর হয়ে পড়ে যান। চাচার করুণ মৃত্যুতে বুকের ভেতরটা তখন খামচে ধরে।
এরপর লাশগুলোকে স্তূপ করে ওরা পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ছোটভাই পান্নার শরীর গুলিতে ঝাজরা হয়ে গিয়েছিল। আগুনে এক হাত বেকেও যায়। ভগ্নিপতি মহসীন ভাইয়ের বুক ও পেটে গুলি লেগে ভোগলা হয়ে যায়। থানাপাড়ায় আনুমানিক ১৩শ মানুষ শহিদ হয়েছেন। গোটা গ্রামে এমন কোনও পরিবার পাবেন না যে কেউ শহিদ হয়নি। অথচ স্বাধীনতা লাভের পর কোনও সরকারই শহিদদের তালিকা করেনি, করার চেষ্টাও হয়নি।আর্থিক সুবিধার দরকার নেই, রাষ্ট্র তো শহিদ পরিবারগুলোর সম্মানটা অন্তত দিতে পারতো।তাহলে শহিদ পরিবারগুলোকে কি রাষ্ট্র বোঝা মনে করে?''
জিন্নাতুল আলমের প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে পারিনি। বরং রাষ্ট্র কেন শহিদ পরিবারগুলোর প্রতি উদাসীন ছিল সে প্রশ্ন আমাদেরও।
স্বাধীন এই দেশের মাটির সঙ্গে মিশে আছে লাখো শহিদের রক্ত। তাদের কথা ভুলে গেলে, একাত্তরের রক্তঋণ কখনোই শোধ হবে না। শহিদদের তালিকা না হওয়া এবং শহিদ পরিবারগুলোর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে আজও দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
স্বাধীনতা লাভের পর বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ ভাতাসহ সরকারের নানা সুবিধা বা সম্মান লাভ করলেও দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা শহিদের পরিবারের খোঁজ রাখেনি কেউই। ফলে পাকিস্তানের অন্যায়, অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে জীবন দিয়ে স্বাধীনতা আনলেও শহিদ পরিবারগুলোর প্রতি বৈষম্য ও অবহেলা থেকেই গেছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার হাত ধরেই এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন অন্তবর্তীকালীন সরকার।তাই শহিদ স্বজনদের অনেকে জানতে চান- একাত্তরের শহিদদের তালিকা ও শহিদ পরিবারগুলোকে স্বীকৃতি প্রদানে এ সরকার কি কোনো উদ্যোগ নেবে?
অন্তবর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে উদযাপিত হবে এবারের বিজয় দিবস। কেমন হবে সেটি- তা নিয়েও চলছে বিস্তর আলোচনা। অনেকেই বলছেন বিবর্ণ বিজয় দিবস পালিত হবে এবার। যেরকম পঁচাত্তরের পরবর্তী সময়গুলোতে হয়েছিল।
কেন এমন সমালোচনা?
অন্তবর্তীকালীন সরকার বিজয় দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজনে বরাদ্দ আগের চেয়ে বাড়িয়ে তিনগুণ করলেও (গত বছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল তিন কোটি ৮৭ লাখ টাকা, এ বছর বাড়িয়ে ৯ কোটি ২১ লাখ ২৫ হাজার টাকা করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক
মন্ত্রণালয়) অনুষ্ঠানের পর্ব কমিয়ে দিয়েছে। বাদ দেয়া হয়েছে কুচকাওয়াজ ও শিশু-কিশোরদের ডিসপ্লের মতো আয়োজন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণামূলক আলোচনা পর্বটিও থাকছে না এবার। এ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘‘আগে যে প্রচলিত কুচকাওয়াজ হতো, এতে জনগণের
সম্পৃক্ততা থাকতো না, সেখানে স্কাউট ও স্বেচ্ছাসেবকরা থাকতো।তার সঙ্গে অন্যান্য বাহিনী থাকতো। এতে সরাসরি জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল না। এবার শিশু, নারী, পুরুষ সব শ্রেণির জনগণকে সম্পৃক্ত করা হবে। তাই কুচকাওয়াজের পরিবর্তে প্রতি উপজেলায় আয়োজন করা হবে বিজয় মেলার।'' (সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১০ডিসেম্বর ২০২৪)।
বিজয় দিবস উদযাপন স্বাধীন দেশের একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। এটি কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠান নয়। বহুবছর ধরে এ জাতীয় অনুষ্ঠানকে ঘিরে এক মাস আগ থেকেই সারা দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা কুচকাওয়াজ ও ডিসপ্লের অনুশীলন শুরু করে। ডিসপ্লে-তে চলে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের নানা ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টাও। এসব আয়োজন শিশু-কিশোরদের মনোজগতে যেমন মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের স্বাধীনতার বিষয়ে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করে, তেমনি তাদের মনে তৈরি হয় দেশাত্ববোধও।
বর্তমান সময়ে এমন আয়োজনে শিশু-কিশোরদের যুক্ত রাখাটাই বরং যুক্তিযুক্ত ছিল। আর এই কুচকাওয়াজ ও ডিসপ্লে অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই ব্যাপক সংখ্যক মানুষের সম্মীলন ঘটে প্রতিটি উপজেলায়।
তাই এটির বিকল্প কোনোভাবেই বিজয় মেলা নয়। বরং সরকার কুচকাওয়াজ ও ডিসপ্লের পাশাপাশি বিজয় মেলারও আয়োজন করলে একাত্তরের প্রতি তাদের বিশেষ শ্রদ্ধার জায়গাটিও মানুষের কাছে স্পষ্ট হওয়ার সুযোগ ঘটতো।
এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ দিবসে তাদের বীরত্বের ইতিহাস ও স্বপ্নের বাংলাদেশ নিয়ে নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে থাকেন। সেখানে যেমন আবেগ থাকে, তেমনি থাকে স্বাধীন দেশকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নেয়ার দৃপ্ত আহ্বান। তাই অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা যারা ছিনিয়ে আনলেন, তারা কোন বাংলাদেশ
প্রত্যাশা করছেন- সেটি শোনাও রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের অংশ হওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশিষ্টজনের। তাই এ বছরে বিজয় দিবসের পরিবর্তিত আয়োজন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে অন্তবর্তীকালীন সরকারের মনোভাব নেতিবাচক রূপে স্পষ্ট হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
শুরু থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধপ্রশ্নে অন্তবর্তীকালীন সরকার নিজেদের অবস্থান সুষ্পষ্ট করতে পারেনি। অন্যদিকে নানা কারণে এ সরকার স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা তথ্য নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। আবার শেখ হাসিনার সরকারের আমলের দুর্নীতি, দুঃশাসন ও দমন-পীড়নের কারণ দেখিয়ে একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভূমিকাকেও অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। ফলে, সাধারণের মনেও নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
তবে দেরিতে হলেও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে নিরবতা ভাঙেন প্রধান উপদেষ্টা। ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত অনুষ্ঠানের বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘মুক্তিযোদ্ধারা বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের যে স্বপ্ন নিয়ে রাষ্ট্রকে স্বাধীন করেছিলেন, আমি তাঁদের সেই স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা এখন থেকে বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই, যেখানে সত্যিকার অর্থে জনগণই হবেন সব ক্ষমতার মালিক।''
মুক্তিযুদ্ধকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও পরিচিতি লাভ করেছে। দেশ স্বাধীন করার মহান ব্রত নিয়ে '৭১–এর ২৫ মার্চ কালরাত থেকে বাঙালি সেনারা সেনানিবাস ত্যাগ করে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একই সঙ্গে এই দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, সাধারণ মানুষ—সবাই যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। পরবর্তী সময়ে যা একটি জনযুদ্ধে রূপ নেয়। আমাদের মা–বোনেরা মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ বিভিন্নভাবে যুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন।' (সূত্র: প্রথমআলো, ২১ নভেম্বর ২০২৪) আমরাও চাই প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যটি সত্যি হোক।তার নেতৃত্বে
অন্তবর্তীকালীন সরকার একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকুক। তা না হলে একটি পক্ষ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের ইতিহাসকে ম্লান করবে, প্রশ্নবিদ্ধ করবে একাত্তরের সব অর্জন ও বিজয়গাথা। একাত্তরকে বাদ দিয়ে সত্যিই কি আমরা এগোতে পারবো? উত্তরটি অবশ্যই- না।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্বের ইতিহাস, আমাদের শেকড়। ব্যক্তি ও দলের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে।কিন্তু দেশের প্রশ্নে সকলের এক হওয়ার ভিত্তি হোক গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধ।