নাগরিকপঞ্জি ও মোদী-মমতার সাক্ষাৎ
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯দিন কয়েক আগে নতুন দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ অনেকেই ভেবেছিলেন আসামের পর পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকপঞ্জি নিয়ে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে আলোচনা করবেন৷ কিন্তু মমতা সে আলোচনা তো করলেনই না, বরং বৈঠকের পর নাগরিকপঞ্জি বিষয়ে নিজের সুর বদল করেছেন৷ পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি নিয়ে মোদীর সঙ্গে কোনো কথা হয়নি, নিজেই জানিয়েছেন৷ আবার পরদিন অমিত শাহর সঙ্গে বৈঠকে আসামের এনআরসি নিয়ে কথা বলেছেন!
ওদিকে, ভারতীয় জনতা পার্টি পশ্চিমবঙ্গে এনারসির পক্ষে সওয়াল করে জোরদার প্রচার চালাচ্ছে৷ দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ, রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানী এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্গের নেতা মোহন ভাগবতরা বলছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি চালু করা হবেই৷ কেউ রুখতে পারবে না৷’’ এখন পরিস্থিতি এমন যে, রাজ্যজুড়ে নাগরিকদের মধ্যে সরকারের গ্রহনযোগ্য নথি সংগ্রহের হিড়িক শুরু হয়েছে৷ ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন৷ রাজ্যের অন্য বিরোধী দল সিপিআই (এম) বলছে, কিছুতেই রাজ্যে এনআরসি হবে না৷ করতেও দেওয়া হবে না৷ এহেন বিরোধিতার পেছনে যুক্তি হিসেবে বামপন্থিরা বলছেন, পশ্চিমবাংলার মানুষ প্রতিবেশী দেশ থেকে ভিটেমাটি ছাড়া মানুষদের আশ্রয় দিয়েছেন৷ বুকে আগলে রেখেছেন৷ এখন রাজনৈতিক স্বার্থে এনআরসি করা চলবে না৷ একই বক্তব্য জানাচ্ছেন অপর বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতারা৷ রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসেরও বক্তব্য একই৷ কিন্তু তারা শুধুমাত্র বক্তব্য জানিয়েই ক্ষান্ত নন, দলের সর্বময় নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এনআরসির বিরুদ্ধে পদযাত্রা করছে তৃণমূল৷ নানা এলাকায় সভা-সমিতি করা হচ্ছে৷ কিন্তু এই নিয়ে রাজনৈতিক মহলে এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যেও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে৷
কী সেই প্রশ্ন? পশ্চিমবঙ্গে যখন তৃণমূল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এনআরসি-র বিরোধিতায় এত দৌড়ঝাঁপ করছেন, তখন দেশের রাজধানী নতুন দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেও নাগরিকপঞ্জি নিয়ে চুপ রইলেন কেন? সাপে-নেউলে সম্পর্ক শিকেয় তুলে রেখে আচমকা হলুদ গোলাপের স্তবক হাতে তাঁর বৈঠক তাহলে কী উদ্দেশে?
‘‘আমাদের দেশে নাগরিকত্ব ঠিক হয় সংবিধান ও আইন অনুযায়ী৷ কোনো ধর্ম, প্রদেশ, জাতি, বর্ণের ভিত্তিতে হয় না৷ বিজেপি নেতারা বলছেন, হিন্দুদের ভয় নেই৷ অর্থাৎ, মুসলমানদের তাড়ানো হবে৷ পশ্চিমবঙ্গে নয় জন আত্মহত্যা করেছেন৷ ২০০৫ সালে সংসদে মমতাই প্রথম রাজ্যে অনুপ্রবেশকারীর তত্ত্ব তুলে ধরে স্পিকারের মুখে কাগজ ছুঁড়ে মেরেছিলেন৷ এখন তিনি রাজ্যে হইচই করছেন, কিন্তু, নতুন দিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এনআরসি নিয়ে কথা বললেন না কেন? মানুষ বুঝেছেন মমতা আসলে কী চাইছেন৷’’
এই বিষয়টিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুজিত রায় ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানালেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক সেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে ফিরে এসে যে রাজনীতি শুরু করেছেন, তা মারাত্মক৷ মমতা ও তাঁর দলের কর্মীরা যে ধরনের প্রচার করছেন, তার মূল কথা হলো, পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাঙালি খেদাও অভিযান শুরু করতে চাইছে বিজেপি৷ ভয়ে সরকারি দপ্তরে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করছেন৷ সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে পরিস্থিতি আরো খারাপ৷’’ তাঁর প্রশ্ন, শাসক দল যদি এমন গুজব ছড়ানোয় উদ্যোগ নেয় তাহলে সাধারণ মানুষ যায় কোথায়?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষা ও নিজের দলের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এনআরসি নিয়ে দ্বিচারিতা করছেন৷ তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে নাগরিকপঞ্জির প্রতিবাদে রোজই মুখ খুলছেন৷ আশ্বাস দিচ্ছেন, কাউকে তাড়ানো হবে না৷ মোদীর সঙ্গে বৈঠক থেকে বেরিয়ে মমতা বলেছেন, ‘‘নাগরিকপঞ্জি তো আসামের ব্যাপার!’’