1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন না হলে কাঙ্খিত ফল মিলবে না’

৯ এপ্রিল ২০২১

অনেক ক্ষেত্রে নারী এগোলেও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া কাঙ্খিত মর্যাদাপূর্ণ স্থান পাওয়া নারীদের পক্ষে সম্ভব হবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান৷

https://p.dw.com/p/3rmwl
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
ছবি: DW

ডয়চে ভেলে : মামুনুল হকের রিসোর্টের ঘটনাটি সম্পর্কে আপনার মতামত.....

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : দু'জনই তো পূর্ণবয়স্ক৷ তারা যখন নিজস্ব সম্মতিতে কোথাও যান বা বসেন বা আলাপ-আলোচনা করেন, সেটা তো কোনো আইনের বরখেলাপ হয়েছে বলে আমি মনে করি না৷ এখানে মুশকিল হয়ে গেছে যে, মামুনুল হক সমাজে একটা ইমেজ তৈরি করেছেন ধর্মীয় নেতা হিসেবে৷ একজন ধর্মীয় নেতার কাছে সমাজের কিছু প্রত্যাশা থাকে৷ এই প্রত্যাশার বিপরীতে যখন তিনি কাজ করেন এবং এর মধ্যে যখন রাজনীতি জড়িত থাকে, তখনই বিষয়টা এরকম জটিল হয়ে যায়৷ ওই নারীর সঙ্গে যদি মামুনুল হক না গিয়ে এমন কেউ যেতেন, যার ধর্মীয় বা রাজনৈতিক পরিচয় নেই, তাহলে বিষয়টি এতদূর যেতো না৷

এ ঘটনায় নারীর সম্মানহানির বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে...

প্রথম থেকেই যেটা উচিত ছিল ওই নারী পরিচয় প্রকাশ না করা৷ ব্যাপারটা খুবই রহস্যজনক৷ মামুনুল হক একটা জায়গায় গেলেন আর সেখানে শত শত লোক পৌঁছে গেল উনি একজন নারীকে নিয়ে গেছেন সেই কথাটা বলার জন্য৷ শত শত লোক এই খোঁজ পেলো কোথায়? আমাদের কী হয় জানেন, কোনো একটা বিষয়ে আমরা যখন কাউকে কাবু করতে চাই তখন তার নারীঘটিত কেলেঙ্কারি বের করার চেষ্টা করি৷ এমনকি আমরা এমনও দেখেছি, একজন ব্যক্তি অপহৃত হয়েছেন, ফেরত আসেননি, তার চরিত্র নিয়ে এমন অনেক কথা হয়েছে৷ মুশকিলটা হয় কী, আমি যখন আমার রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব জড়াবো, আইনগত প্রক্রিয়ায় রাখি না রাখি আমরা সমস্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে ব্যবহার করে, কিছু কিছু গণমাধ্যম যেগুলো আমার পক্ষে কথা বলবে, তাদের ব্যবহার করে এই কাজটা করবো৷ প্রথম থেকেই নারীর পরিচয় একেবারেই গোপন রাখা উচিত ছিল৷ এটা একেবারে গণসমাবেশের মতো হয়ে গেল কেমন করে? গণসমাবেশ যখন হয়ে যায়, তখন এই সমস্ত বিষয়ে যে সংবেদনশীলতা দেখানোর কথা, আপনি সেই সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করেন না৷ এই গণসমাবেশটা করাই হয় বিষয়টা জনগণের হাতে তুলে দিয়ে একটা মুখরোচক আলোচনা তুলে দেওয়ার জন্য৷ বিষয়টা যখন আমরা রগরগা করে প্রচার করবো, তখন একজন নারী তো ক্ষতির মুখে পড়বেন৷ আমাদের সমাজে যাবতীয় দায়টা কিন্তু এক সময় নারীকেই বহন করতে হয়৷ তার নাম-পরিচয় গোপন না রেখে উল্টো তার ছেলে, বাবা, মা সবার সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে৷ বিষয়টা এতটাই অসহনীয় করে তোলা হচ্ছে, ওই নারীর যে সমাজ, সেখানেও জনে জনে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তিনি মামুনুল হককে বিয়ে করেছেন কিনা৷ এটা কী আমাদের রাজনীতি বা ধর্মের বিষয় হলো?

নারীর প্রতি যেমন ভাষা ব্যবহার হয়, সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত?

সেটা তো একেবারেই যুক্তিযুক্ত না৷ গোটা প্রক্রিয়া থেকে উঠে এসেছে যে, আমরা যতই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি না কেন, সমাজে নারীর দুর্বল অবস্থার কথা বিবেচনা করে নারীর প্রটেকশনের কথা বলি না কেন, যখন আমাদের রাজনীতি সামনে চলে আসে, তখন আমরা আর সেগুলোর কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করি না৷ একজন নারীর কী হবে? সন্তানদের কী হবে? মামুনুল হকের স্ত্রীর কী হবে? তার সন্তানদের কী হবে? এগুলো আমরা কখনোই বিবেচনায় আনি না৷ এখন আপনি বলতে পারেন, মামুনুল হক তো নিজেই দায়িত্ব-জ্ঞানহীনের মতো কাজ করেছেন? সেটা তার পরিবার আর ওই নারীর পরিবার মিলে ঠিক করতো৷ তার দায়িত্ব তো কিছু প্রচারমাধ্যম আর রাজনৈতিক দল নিয়ে নিতে পারে না৷ সেটার বিচার প্রাথমিকভাবে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে চেষ্টা করবো৷ না হলে তখন আমরা আইনের কাছে যাবো৷ কিন্তু ওই নারী বা তার পরিবার বা মামুনুল হকের পরিবারের সদস্যদের প্রতি নূন্যতম সংবেদনশীলতা আমরা দেখাইনি৷ ধর্ষণ মামলায় একটি নারীকে একটু বাড়তি প্রোটেকশন দেওয়া হয়, এখানে সেই সংবেদনশীলতাও আমরা দেখাইনি৷ আমরা আইন করি ঠিকই, কিন্তু আইনের প্রতি যে সংবেদনশীলতা থাকা দরকার, সেটা আমাদের মোটেও নেই৷ রাজনীতির প্রয়োজনে আমরা যা খুশি তাই করে ফেলতে পারি৷  

আপনার কী মনে হয়, নারীর প্রতি পুরো সম্মান দিতে আমরা সমর্থ হয়েছি?

একদমই না৷ বাংলাদেশে প্রত্যেক ৪ জন নারীর একজন নির্যাতিত হচ্ছেন৷ নারী নির্যাতনের হার বাংলাদেশে অনেক বেশি৷ এই নির্যাতন যে শুধু শারীরিক নির্যাতন তা তো না৷ এই নারী ও মামুনুল হকের স্ত্রী প্রতিটা সেকেন্ড যে নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গেছেন, তাদের আমরা কোন মুখে বলবো যে, আমরা নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করি? এই ধরনের ঘটনা যে সমাজে ঘটছে না তা তো নয়, ঘটছে৷ সেই ঘটনাগুলোকে তো আমরা অন্যভাবেও মীমাংসা করতে পারতাম৷ যেহেতু আমাদের টার্গেট মামুনুল হক, সেই কারণে এই নারী বা তার স্ত্রীর কী হলো সেটা আমরা বিবেচনায় আনিনি৷ যেভাবে কয়েকটি গণমাধ্যম এটা প্রচার করেছে, সেটা দেখে আমার মনে হয়েছে, সংবেদনশীলতার জায়গায় আমাদের অবস্থা খুবই নাজুক৷

এখন অনেক ক্ষেত্রেই তো নারীরা সামনের আসনে বসে আছেন, তারপরও... 

নারীরা সামনের আসনে বসে থাকলেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে সেটা তো আমি বলতে পারি না৷ যে নারী সামনের আসনে আসেন, অনেক সময় পরিবারতন্ত্রের কারণে আসেন, অনেক সময় নিজস্ব যোগ্যতা প্রমাণ করে আসেন, অনেক সময় বৈরি পরিস্থিতি পার করে আসেন৷ তিনি সামনে এসেছেন বলে যে, নারীবাদ এদেশে দর্শন হয়ে গেছে, সমান অধিকার বা সাম্য এদেশে দর্শন হয়ে গেছে এটা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই৷ এখনো এই সমাজে পুরুষতন্ত্র প্রবল প্রতাপ নিয়ে বিদ্যমান আছে৷

রাজনৈতিকভাবে বা আন্দোলন-সংগ্রামে নারীকে কিভাবে দেখা হয়?

রাজনৈতিকভাবে দেখেন আমরা সংরক্ষিত নারী আসনের বাইরে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচন করছেন, সেভাবে আমরা কিন্তু দেখছি না৷ রাজনীতি এখানে অন্য শক্তিগুলোকে নির্দেশিত করে থাকে৷ এখানে নারীর অংশগ্রহণ কম দেখি৷ স্থানীয় সরকারেও নারীকে কোটা দিয়ে অংশ নেয়াচ্ছে৷ নারী নির্বাচিত হয়ে আসছে, কিন্তু তাকে তো কাজের ভার দেওয়া হচ্ছে না৷ ক্ষমতা বা অর্থ দেওয়া হচ্ছে না৷ প্রফেশনাল অনেক ক্ষেত্রে যদি নারী এগিয়েও থাকে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নারী যদি উদ্যোক্তা হয়ে এগিয়েও থাকে, কিন্তু ক্ষমতার যে মূল জায়গা, রাজনীতি সেখানে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীকে প্রতিষ্ঠিত করা, নারীকে আইনের মাধ্যমে শক্তিশালী করা- সব জায়গায় ফাঁক রয়ে গেছে৷ সবচেয়ে বড় কথা কী জানেন, মুসলিম-প্রধান এই দেশে আমি যখন বড় হয়ে উঠি, তখন থেকেই আমি বুঝতে শিখি, আমি আমার ভাইয়ের অর্ধেক আর আমার ভাই শেখে সে তার বোনের দ্বিগুন৷ মুসলিম অনেক দেশেই কিন্তু সম্পত্তিতে সমান অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে৷ ইসলামি যে পারিবারিক আইনে আমরা এখন চলি, সেখানেও একজন মুসলমান চাইলে তার সম্পদ ভাগ করে দিতে পারেন৷ সেগুলো আমরা প্রচার করি না, প্র্যাকটিসও করি না৷ পরিবার বা রাজনীতিতে আমূল কোনো পরিবর্তন হয়েছে সেটা আমি মনে করি না৷ তবে অর্থনৈতিক ও পেশাগত ক্ষেত্রে নারী অনেক দূর এগিয়েছে৷ তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে নারী শক্তিশালী জায়গায় গেছে বলে আমি দেখি না৷

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

বিভিন্ন পেশায় নারীরা কাজ করছেন, সেখানে তাদের কী ধরনের অমর্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়? বিশেষ করে বিউটি পার্লার বা এমন আরো কিছু ক্ষেত্রে?

দেশের অধিকাংশ বিউটি পার্লারে দেখবেন, যারা কাজ করেন, তাদের আমরা আদিবাসী বলি, কিন্তু সরকার বলতে বারণ করেন৷ তারা যে এলাকা থেকে এসেছেন সেখানে যদি বন, পাহাড় প্রকৃতি আগের মতো থাকতো, তাহলে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ পেশায় আসতে হতো না৷ এটা কিন্তু এক ধরনের মানসিক নির্যাতন৷ বাংলাদেশে গার্মেন্টসে অনেক নারী কাজ করছেন, সেখানে যৌন নির্যাতন অনেক বেশি৷ পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যৌন হয়রানির বড় কয়েকটি উদাহরণ আমরা পেয়েছি৷ আমরা এখনো তনু হত্যার বিচার পাইনি৷ কয়েকদিন আগে তিনজন পুরুষ মিলে একজন নারীকে জোর করে যৌনকাজে বাধ্য করেছে এমন ভিডিও ছাড়া হয়েছে, কিন্তু আমরা এর বিচার পাইনি৷ আমরা যারা ওকালতি পেশায় আছি, সেখানে আমাদের অনেক হ্যারাসমেন্ট নিতে হয়৷ আমাদের সংসারে বাচ্চার কাজ নারী ও পুরুষ মিলে করার ওই ওরিয়েন্টেশনটা হয়নি৷ সেখানে আমি অনেক জায়গায় দেখেছি, নারীরা পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন৷ ওখানে যদি বাচ্চাদের দেখার একটা জায়গা থাকে, তাহলে অনেক নারী কিন্তু চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন না৷

নারীদের সম্মান রক্ষায় মিডিয়ার ভূমিকা কেমন হতে পারে?

মামুনুল হকের ঘটনা থেকেই আমি দেখলাম আমাদের মিডিয়া কিন্তু রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে জেন্ডার জাস্টিসকে প্রাধান্য দিতে পারলো না৷ আমি মনে করি, জেন্ডার জাস্টিসের বিষয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীলতা, বিশেষ করে এই প্রজন্মের সাংবাদিকদের মধ্যে তৈরি করা উচিত৷ আপনি দেখেন, তারা যদি সংবেদনশীল হতেন, তাহলে এই নারীকে আজকে যে অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে, সেটা হতো না৷ নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখা যায়৷ যেখানে নির্যাতনের ঘটনা অনেক বেশি, সেখানে নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরা, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে প্রশাসনের যোগসূত্র করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন৷

কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে কি নারীর সম্মান রক্ষা করা সম্ভব?

কেবল হয়তোবা না, তবে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন যদি না হয় তাহলে অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন হলেও তার কাঙ্খিত ফল আমরা দেখতে পাবো না৷ আমি মনে করি, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন অনেক বড় বিষয়৷ এটা চর্চার মাধ্যমে আসতে হবে৷ সেটার জন্য চর্চার ক্ষেত্রটা তৈরি করতে হবে আমাদেরকে৷

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান