নির্বাচনের সময় কিশোর গ্যাং বাড়ার আশঙ্কা
১৪ অক্টোবর ২০২৩বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় পর্যায়ের অপরাধী চক্র ও রাজনৈতিক নেতারা এইসব কিশোর গ্যাং-এর নেপথ্যে আছে৷ আর নির্বাচনের কাজে লাগাতে তারা নতুন নতুন গ্যাং তৈরিতে ইন্ধন দিচ্ছে৷
গত ২৪ আগস্ট ঢাকার দক্ষিণখান এলাকায় কিশোর গ্যাং-এর সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে রাফসান নামে ১৭ বছরের এর কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়৷ এই হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আরেক কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ পুলিশ জানিয়েছে সিগারেট খাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে৷
এর আগে গত ১৭ মে ঢাকার মিরপুরে এক স্কুল ছাত্রকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা৷ কিশোর গ্যাং-এ যুক্ত হতে না চাওয়ায় সিয়াম (১৪) নামের ওই কিশোরকে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে৷ নিহত কিশোরের পরিবারের অভিযোগ, ওই কিশোর গ্যাং-এর পিছনে প্রভাবশালীরা জড়িত৷ পুলিশ আট জনের বিরুদ্ধে মামলা নিলেও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি৷
গত জুন মাসে ফেনীতে এক স্কুল ছাত্রকে মারধর করে কিশোর গ্যাং-এর তিন সদস্য গ্রেপ্তার হয়৷ তারা ওই স্কুল ছাত্রকে মারধরের পর তার ভিডিও ধারণ করে আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলো৷
একই মাসে ফেনী থেকেই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে কিশোর গ্যাং-এর চার সদস্যকে আটক করা হয়৷ তারা কথিত ‘‘নুরু গ্যাং''-এর সদস্য৷ তাদের কাছ থেকে ছুরি ও চাকু উদ্ধার করা হয়৷
পুলিশ জানায় প্রায় ১৫ বছর আগে ঢাকার উত্তরা এলাকায় কিশোর গ্যাং-এর তৎপরতা প্রথম নজরে আসে৷ এরপর তা আর কখনোই থামেনি৷ সেই কিশোর গ্যাং এখন ঢাকাসহ সারাদেশে এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে৷ গত জুলাই মাসে পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা কিশোর গ্যাং পরিস্থিতি নিয়ে একটি বৈঠক করেন৷ তারা তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেন যে কিশোর গ্যাং কালচার সারাদেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে৷ তারা বিশ্লেষণে দেখেন হত্যা থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই যাতে কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা জড়িত নয়৷ তাদের এই অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে৷ ওই বৈঠকে উপস্থিত একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ‘‘কিশোর গ্যাং গুলোর নেপথ্যে আছে প্রভাবশালীরা৷ বিশেষত রাজনৈতিক নেতা এবং হোয়াইট কলার ক্রিমিন্যালরা কিশোর গ্যাং-এর নেপথ্যে থাকে৷ তারা তাদের রাজনৈতিক শো-ডাউন থেকে শুরু করে নানা অপকর্মে এইসব গ্যাংকে কাজে লাগায়৷ অস্ত্র দেয়, অর্থ দেয়৷ ফলে গ্যাং-এর সদস্যরাও নিজেদের ক্ষমতাধর মনে করে এবং কাউকে পরোয়া করতে চায়না। জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধে৷’’
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানা গেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২২৫টি৷ ওই সদস্যরা আলাদা আলাদাভাবে ১১০টি গ্যাং-এর সদস্য৷ আর ১১০টি গ্যাং-এর সদস্য প্রায় এক হাজার৷ ওই সময়ে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের ৫২৯ জন সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে৷ কিশোর গ্যাং-এর সদস্যদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে৷
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ৫২টি৷ সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০০৷ ঢাকায় মিরপুরে এখন কিশোর গ্যাং সবচেয়ে বেশি৷ পুলিশের হিসাবে পুলিশের মিরপুর বিভাগে ১৩টি কিশোর গ্যাং-এর ১৭২ সদস্য সক্রিয়৷ কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা এলাকাভিত্তিক মাদকের কারবার, মাদকসেবন, মাদক সরবরাহ, ছিনতাই, ইভটিজিং, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি এমনকি খুনের মতো অপরাধেও জড়িত বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে৷
পুলিশের ওই বৈঠকে আগামী নির্বাচনে কিশোর গ্যাং সক্রিয় হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীরা তাদের কাজে লাগাতে পারে৷ সেটা হলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে৷ গাজীপুর সিটিসহ স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে কিশোর গ্যাং-এর কদর দেখা গেছে৷
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উপ পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘‘হতাশা আর হিরোইজম থেকে কিশোর গ্যাংগুলো তৈরি হয়৷ একেক এলাকায় কিশোর গ্যাং-এর প্রেক্ষাপট একেক রকম৷ অভিজাত এলাকায় উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোররা হিরোইজম থেকে কিশোর গ্যাং-এ যুক্ত হয়৷ আবার বস্তি বা নিম্নবিত্ত এলাকায় এটা হয় হতাশা থেকে৷ তবে এখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব তাদের প্রলুব্ধ করে৷ গ্রুপগুলো তাদের কাজের জন্য এই মাধ্যমগুলো ব্যবহারও করে৷’’
তার কথা, ‘‘এই কিশোর গ্যাংগুলো স্বাধীনভাবে গড়ে উঠলেও অনেক সময়ই স্থানীয় পর্যায়ের বড় অপরাধী, গডফাদার বা রাজনৈতিক নেতারা তাদের ব্যবহার করে৷ বিশেষ করে মাদক ব্যবসায়ী ও সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র তাদের কাজে লাগায়৷ এমনকি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রও তাদের ব্যবহার করে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আইন শৃঙ্খলার জন্য এই কিশোর গ্যাংগুলো উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আর যদি আগামী নির্বাচনে তাদের স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা ব্যবহার করেন তাহলে তাও হবে উদ্বেগের বড় কারণ৷ এখন পর্যন্ত তাদের তেমন ব্যবহার করা হয়েছে বলে আমাদের কাছে তথ্য নেই৷ কারণ এই সময়ে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে তাতে ভোটার তেমন ছিলো না৷ তবে তাদের ব্যবহার করা যায়৷ এটাই আশঙ্কার বিষয়৷’’
বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন৷ তিনি তার গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ‘‘নন্দিত শৈশব এবং বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ ও গ্যাং কালচার'' শিরোনামে একটি বইও প্রকাশ করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘কিশোর অপরাধের ইতিহাস অনেক পুরনো। তবে সেই সময়ে তা সহনীয় পর্যায়ে ছিলো৷ এখন কিশোর গ্যাং গুলো হত্যাকাণ্ডসহ বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে৷ এর মূল কারণ পারিবারিক শাসন এবং মূল্যবোধের ধস৷ একই সঙ্গে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি কিশোরদের অপরাধ ও অপরাধের কৌশলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে৷ এখানে তেমন নজরদারি নেই৷ আর তাদের জন্য খেলাধুলা ও বিনোদনের পরসিরও সীমিত হয়ে গেছে৷ ফলে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে৷’’
তার কথা, ‘‘এই কিশোরদের আবার সংঘবদ্ধ অপরাধীরা, হোয়াইট কলার ক্রিমিনালরা ব্যবহার করায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। কিশোরদের ভিতর এক ধনের হিরোইজম ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ যা তাদের অপরাধে যুক্ত করছে৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘সামনের নির্বাচনে এই কিশোর গ্যাংগুলোকে ব্যবহার করা হতে পারে। সেটা হলে এই গ্যাং আরো বাড়বে’’
‘‘পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একা এখানে কিছু করতে পারবে না৷ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে৷ বয়ঃসন্ধিকালের এই কিশোরদের সবাই মিলে ঠিক মতো গাইড করতে হবে৷ তাদের সামনে ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে৷ তাদের বিকাশের ভালো পরিবেশ দিতে হবে৷ তা না হলে এই কিশোর গ্যাং কালচার রোধ করা কঠিন,’’ মনে করেন এই অধ্যাপক৷