পরিযায়ীদের আগমনে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ
৩০ মে ২০২০গোটা দেশের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অপেক্ষাকৃত কমই ছিল৷ কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফেরা শুরু হওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই হার বেড়ে চলেছে৷ দীর্ঘ দু'মাসের লকডাউন পর্ব পার করে পশ্চিমের রাজ্যগুলি থেকে ট্রেনে করে শ্রমিকদের প্রত্যাবর্তন শুরু হয়েছে৷ এখনো পর্যন্ত তিন লাখের বেশি শ্রমিক রাজ্যে পৌঁছেছেন৷ বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, হুগলিসহ বিভিন্ন জেলায় এসে পৌঁছেছে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন৷ এই ট্রেন থেকে নামার পর শ্রমিকদের থার্মাল স্ক্রিনিং করা হচ্ছে৷ রাখা হচ্ছে অস্থায়ী তাঁবুতে৷ তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে নির্দিষ্ট জেলায়৷ শ্রমিকরা মূলত আসছেন মহারাষ্ট্র ও গুজরাত থেকে৷ ভারতে সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমণ হয়েছে মহারাষ্ট্রে৷ এর ফলে গত কয়েক দিনে পশ্চিমবঙ্গে করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই৷ এই রোগীদের সিংহভাগই পরিযায়ী শ্রমিক৷
পূর্ব বর্ধমান থেকে বাঁকুড়া, হুগলি থেকে বীরভূম, সর্বত্রই একই ছবি দেখা যাচ্ছে৷ বৃহস্পতিবারের বুলেটিন অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় ৩৪৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন৷ একদিনের হিসেবে এই হার সর্বোচ্চ৷ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বেড়ে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে সাড়ে চার হাজার ছাড়িয়েছে৷ লাফিয়ে বাড়ছে করোনার উপসর্গসহ রোগীর সংখ্যাও৷
বৃহস্পতিবার ১৭টি ট্রেনে মহারাষ্ট্রের মুম্বই, পুনে, সোলাপুর, নাগপুর থেকে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক পশ্চিমবঙ্গে ফিরেছেন৷ গুজরাতের জামনগর থেকে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন এসে পৌঁছেছে পুরুলিয়ায়৷ রাঢ়বঙ্গের এই জেলা এতদিন গ্রিন জোনে ছিল৷ সেখানেও এই সপ্তাহে প্রথম করোনা আক্রান্তের সন্ধান মিলেছে৷
কীভাবে রাজ্য সরকার এই শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিচ্ছে? বাঁকুড়ার ডেপুটি সিএমওএইচ চিকিৎসক সজল বিশ্বাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাইরে থেকে এলে ১৪ দিনের জন্য হোম কোয়ারান্টিনে রাখা হচ্ছে৷ উপসর্গ থাকলে পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ যদি কারো রিপোর্ট পজিটিভ আসে, তাহলে পাঠানো হচ্ছে দুর্গাপুরের সনকা হাসপাতলে৷ পরিযায়ী শ্রমিকরা আসার পর সংক্রমণের হার অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে৷’’
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, ১ মে থেকে এখনো পর্যন্ত ৯১ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক তাঁদের কর্মস্থল থেকে নিজেদের রাজ্যে ফিরে গিয়েছেন ট্রেনে, বাসে৷ ফলে সব রাজ্যই কমবেশি এই সমস্যার মুখে পড়েছে৷ শ্রমিক সংগঠনগুলির বক্তব্য, এই পরিযায়ীদের কথা কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার ভাবেইনি৷ তাই কয়েকশ মাইল হেঁটে বা নদী পার করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ হারানো শ্রমিকরা রওনা দিয়েছেন গন্তব্যের উদ্দেশে৷ চিকিৎসকরাও সংকটের কথা স্বীকার করে মানবিকতার প্রশ্নটি সামনে রাখছেন৷ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের রাজ্য সম্পাদক, চিকিৎসক অংশুমান মিত্র বলেন, ‘‘লকডাউনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই এই প্রক্রিয়া শুরু করতে হতো৷ কিন্তু তখন কর্পোরেট সংস্থা চেয়েছিল, তাদের কারখানা চালানোর জন্য কর্মী রেখে দিতে৷ এখন কাঁচামাল শেষ হয়ে গিয়েছে বলে শ্রমিকদের তাড়িয়ে দিচ্ছে৷’’ তিনি জানান, ‘‘এত বেশি সংখ্যায় নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে রিপোর্ট দ্রুত পাওয়া যাচ্ছে না৷ অনেক প্রতিষ্ঠান নমুনা নিতেও চাইছে না৷’’
নমুনা পরীক্ষা, শ্রমিকদের কোয়ারান্টিনে রাখা থেকে তাঁদের উপর নজরদারি, এই প্রক্রিয়া অবশ্যই ধাক্কা খেয়েছে ঘূর্ণিঝড় আমফানের জেরে৷ এর ফলে পরিযায়ীদের সঙ্গে এলাকাবাসীর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না৷ বিশেষ করে দুই ২৪ পরগনা, হুগলি, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুরে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে ঝড়ে৷ এর মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঢল নামায় নমুনা পরীক্ষার বিষয়টি রাজ্য সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জের হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ রাজ্যের ৩৮টি পরীক্ষণাগারে ৪৫ হাজারেরে বেশি নমুনা পড়ে রয়েছে, যার পরীক্ষা এখনো হয়নি৷ এগুলির অধিকাংশই পরিযায়ী শ্রমিকদের৷ নাইসেড-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রোজ ৫০০টি করে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, যদিও এই হারে পরীক্ষা করলেও জমে থাকা নমুনার ফল পেতে অনেকটাই সময় লাগবে৷ ইতিমধ্যে এসে যাবেন আরো পরিযায়ী শ্রমিক, জমা পড়বে আরো সোয়াব নমুনা৷ ফলে আশঙ্কা বাড়ছে, আগামী দিনগুলিতে যত বেশি সংখ্যায় নমুনা পরীক্ষা করা হবে, রাজ্যে ততই বাড়বে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা৷