ঘোর সংকটে কলকাতার ফুটবল
১৫ এপ্রিল ২০২০'সব খেলার সেরা বাঙালির ফুটবল' এখন করোনার গ্রাসে। অনেক স্বপ্নপূরণ, স্বপ্নভঙ্গ, ইতিহাসের সাক্ষী কলকাতা ময়দানে এ বার ফুটবল নামেনি। প্রথম থেকে পঞ্চম ডিভিশন লিগ কবে খেলা হবে, আদৌ খেলা হবে কি না কেউ জানে না। সাহেবদের হাত ধরে যবে থেকে কলকাতায় ফুটবলের প্রবেশ ঘটেছে, তারপরে কখনও এই ধরনের ঘটনা ঘটেনি। ফলে সংকটে সব ডিভিশন মিলিয়ে হাজার হাজার ফুটবলার। তাঁরা মূলত জেলা থেকে আসেন রুটি-রুজির খোঁজে এবং স্বপ্ন সফল করার প্রয়াসে। এই বঙ্গসন্তান ফুটবলাররা অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের। করোনায় ফুটবল নেই বলে রোজগারও নেই। তাঁরা এখন কার্যত ভিক্ষে করার জায়গায় চলে গিয়েছেন। আর কলকাতার ফুটবল মানে শুধু কয়েক মাসের খেলা নয়, এটা একটা শিল্প। এর সঙ্গে জড়িয়ে থেকে বেঁচে আছে, বল, জার্সি, বুট, মোজা, খাবার সরবরাহকারীরা। বেঁচে আছেন হাজার হাজার ফুটবলার ছাড়াও মালি, ক্যান্টিনে কাজ করা অসংখ্য মানুষ, ময়দান যাঁদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে। এই সংকটের মধ্যে ইস্টবেঙ্গল অবশ্যআগামী মরশুমের জন্য টিম গুছিয়ে নিয়েছে। করোনায় লকডাইনের মধ্যেও তারা একাধিক ফুটবলারের সঙ্গে পাকা কথা বলে নিয়েছে।
কিন্তু বাকি দলগুলির তো সেই অর্থবল নেই। তারা ছোট ক্লাব। অনেকে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসায় নিজের পুঁজি খরচ করেও ক্লাব চালান। করোনা কেটে গেলে কারা কতটা টাকা ঢালতে পারবেন তাও অনিশ্চিত। তাই এক করোনাই কলকাতা ফুটবলের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছে। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা করছেন রূপক সাহা। কলকাতা ময়দান হাতের তালুর মতো চেনেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''এর আগে প্রচন্ড গরমে দিন দশেক খেলা বন্ধ থাকার ঘটনা দুই তিনবার ঘটেছে। এতদিন ধরে খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়া আমি কখনও দেখিনি। প্রতি বছর জেলা স্তর থেকে ছেলেরা কলকাতায় খেলতে আসে। সেই সাপ্লাই লাইনটা বন্ধ হয়ে গেল। কলকাতায় সব ডিভিশন মিলিয়ে এক হাজার ৩০০ মতো খেলা হয়। তাকে জড়িয়ে আছে বহু শিল্প। সেই সব শিল্প প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো।''
কলকাতায় একটি ক্লাব চালান নবাব ভট্টাচার্য। জেলাস্তর থেকে প্রচুর ফুটবলার তিনি তুলে এনেছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''এখনই বলে দেওয়া যায়, সেকেন্ড ডিভিশন থেকে নিচের দিকে লিগের খেলা হবেই না। ফার্স্ট ডিভিশন, প্রিমিয়ার এ ও বি অনিশ্চিত। ৩ মে পর্যন্ত লকডাউন। তার মানে ৪ মে থেকে সব খুলে যাবে তা তো নয়। কড়াকড়ি থাকবে। ফুটবলের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় ৩৫ থেকে ৪০ জনকে এককাট্টা করতে হবে। তার অনুমতি জুন বা জুলাইয়ের আগে পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। পুরো ফুটবল লিগই অনিশ্চিত। আসলে প্রাণ থাকলে তো খেলা হবে। এখন তো প্রাণ বাঁচানোর লড়াই চলছে।''
হতে পারে, কয়েক বছরের চেষ্টায় ময়দান তার হৃতগৌরব ফিরে পাবে। কিন্তু ফুটবলাররা? বিশেষ করে ছোট ক্লাবেযাঁরা খেলেন, তাঁদের কী হবে? দীর্ঘদিন ধরে চুটিয়ে ফুটবল খেলেছেন মেহতাব হোসেন। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন, দীর্ঘ সময় ইস্টবেঙ্গল সহ কলকাতার বড় দলে খেলার পর কিছুদিন আগে অবসর নিয়ে প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন বানিয়েছেন। ডয়চে ভেলেকে মেহতাব বলেছেন, ''আমি দেখছিলাম, প্রচুর খেলোয়াড়ের চাকরি চলে গিয়েছে। এঁদের জন্য কিছু করতে পারলে ভালো হবে। বড় প্লেয়ারদের অসুবিধা হবে না। কলকাতার ফুটবলাররাই সমস্যায়। সাতজন বা পাঁচজন ফুটবলারকে নিয়ে প্রতিযোগিতা সারা পৃথিবীতে হয়। সে সবও এখন বন্ধ। এখানে খেলাকে আমরা বলি খেপ খেলা। সেই খেপ বন্ধ বলে ভয়ঙ্কর অবস্থা হচ্ছে। খেপ খেলে যাঁরা সংসার চালাতেন, তাঁরা কী করবেন? কী হবে আমি জানি না। আইএসএল খেলা বিশ্বজিৎ সাহা রোলের দোকান করেছিল। এখন তিনি নিঃস্ব।''
কয়েক মাস পরে কি লিগ শুরু হতে পারে না? রূপক সাহা বলছেন, ''জুলাই থেকেও লিগ শুরু হলে তিন মাস সময় পাওয়া যায়। তখন আবার বর্ষার সমস্যা। কিন্তু তাও খেলা হতে পারে। মাঠের আবার ভাগের বিষয় আছে। ক্রিকেট শুরু হয় শীতকালে। তখন ফুটবলারদের মাঠ ছেড়ে দিতে হয়।'' মেহতাব আবার মনে করেন, ''সেপ্টেম্বর থেকে মাস দেড়েকের জন্যও যদি লিগ চালু করা যায় তো ফুটবলাররা কিছু টাকা রোজগার করতে পারেন।'' পুরোটাই নির্ভর করবে, কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় তার ওপর।
রূপক সাহার মতে, ''কলকাতা ময়দানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রচুর সংস্থা। চামড়ার ফুটবল, হোশিয়ারি, নেট, বুট, খাবার সহ প্রচুর জিনিস সরবরাহ করা হয়। জলন্ধরের দুই হাজার কোটির ক্রীড়া-শিল্প ধসে গিয়েছে। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে, শুধু বাঙালি নয়, প্রচুর বিদেশি ফুটবলার আসেন, তাঁরাও খেপ খেলে, ক্লাবে খেলে রোগজার করেন। এঁদের সংখ্যাও কম নয়। তাঁরাও ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। কলকাতা ও জেলার ফুটবল মিলিয়ে হাজার পঁচিশেক ফুটবলারের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে।''
অনেক ইতিহাসের সাক্ষী কলকাতার ময়দান। ব্রিটিশদের হারিয়ে মোহনবাগানের লিগ জয়, ইস্টবেঙ্গলের লিগ জয়ের রেকর্ড, প্রবাদ হয়ে যাওয়া গোষ্ঠ পাল, চুনী, বলরাম, পিকে, কৃশাণুদের পায়ের শিল্পকলা, প্লেয়ারদের নিয়ে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের যুদ্ধ, কোটি কোটি মানুষের আবেগের বিস্ফোরণ দেখেছে ময়দান। বাঙালির সেই প্রিয় ফুটবল এখন ঘোর সংকটে। তার থেকেও বেশি সংকটে হাজার হাজার সাধারণ বাঙালি ফুটবলাররা।