শিশুদের ওপর পর্নোগ্রাফির প্রভাব
১৭ জানুয়ারি ২০১৭ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে এ কথাই বলেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান খান রতন৷ তাঁর কথায়, ‘‘শিশু বয়সে পর্নোগ্রাফি দেখলে পরবর্তীতে তার স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক নিয়ে ধারণা ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ অশ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয় বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি৷ এমনকি সামাজিকভাবে অপরাধেও জড়িয়ে পড়তে পারে শিশুরা৷''
ডয়চে ভেলে: পর্নোগ্রাফি কী – সেটা অনেকেই বোঝেন৷ কিন্তু শিশু পর্নোগ্রাফি সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে বললে কী বলা যায়?
ডা. জিল্লুর রহমান খান রতন: শিশু পর্নোগ্রাফিতে শিশুদের ব্যবহার করা হয়ে থাকে৷ এটা একটি গর্হিত কাজ ও অস্বাভাবিক বিষয়৷ এটা বিকৃত মানসিকতার পরিচয়ও বটে৷ তবে শিশু পর্নোগ্রাফি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে৷ ফটোগ্রাফি হতে পারে, আবার ভিডিও চিত্রের মাধ্যমেও হতে পারে৷
এই পর্নোগ্রাফিতে কি কেবল শিশুরাই অংশ নেয়? আর সেজন্যই কি শিশু পর্নোগ্রাফি বলা হয়? নাকি শিশুরা যে পর্নোগ্রাফি দেখে, সেগুলোকে শিশু পর্নোগ্রাফি বলে?
এই পর্নোগ্রাফিগুলো শিশুদের উপযোগী করে বানানোর প্রবণতা থাকতে পারে৷ তবে আজকাল যারা স্কুলে পড়ে, তারাও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছোট ছোট ভিডিও আদান-প্রদান করে৷ তাছাড়া শিশুরা যে শুধুমাত্র শিশুদের নিয়ে তৈরি পর্নোগ্রাফি দেখছে বিষয়টা তো তা নয়৷ তারা ‘অ্যাডাল্ট' বা প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে তৈরি পর্নোগ্রাফিও দেখছে৷ সেই অর্থে শিশুদের ব্যবহার করা অথবা তাদের উপযোগী করে বানানো – শিশু পর্নোগ্রাফি এর যে কোনো একটা হতে পারে৷
বাংলাদেশে শিশু পর্নোগ্রাফি বাড়ার মূল কারণ কী?
শিশুদের পর্নোগ্রাফির প্রতি বেশি আসক্তির প্রধান কারণ হলো – তারা এখন চাইলেই যে কোনো ওয়েবসাইটে ঢুকে যেতে পারে৷ যদিও এ ব্যাপারে সরকার কড়াকড়ি আরোপ করেছে৷ অনেক সাইট বন্ধ করে দিয়েছে এবং এমন অনেক সাইট বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে, নিচ্ছে৷ এটা আসলে সামাজিক অবক্ষয়৷ আর এই সামাজিক অবক্ষয় হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, বাচ্চাদের খেলার মাঠ নেই, আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় আসা-যাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে৷ তাই তারা ফ্লাটবন্দি হয়ে ‘আরবান' সংস্কৃতিতে বড় হচ্ছে৷ এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার মধ্যে বড় হচ্ছে আজকের শিশুরা৷ তাই আমার মনে হয়, তাদের সুস্থভাবে বেড়ে উঠার জন্য খেলার মাঠ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে৷ প্রযুক্তির যেমন ভালো দিক থাকে, আবার খারাপ দিকও থাকে৷ ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় বাচ্চারা সেটা ব্যবহার করছে৷ তাই সেটাও আর নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না৷ ফলে তারা ইন্টারনেটে খারাপ জিনিস দেখছে৷
ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, বিশেষ করে পশ্চিমা ধাঁচের স্কুলগুলো কি শিশু পর্নোগ্রাফি বাড়াতে কোনো ভূমিকা রাখছে?
আমাদের দেশে যে ‘মেইনস্ট্রিম' স্কুলগুলি আছে, সেখানে দিনের শুরুতে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়৷ জাতীয় দিবসগুলো পালন করা হয়৷ কিন্তু দেশীয় সংস্কৃতির বাইরে যেসব স্কুল পরিচালিত হয়, সেসব স্কুলে মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে৷ সেখানে প্রতিযোগিতা করে বাচ্চারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে৷ সেখানে তাদের দেশীয় সংস্কৃতির কিছুই শেখানো হয় না৷ আমি এমন স্কুলও চিনি, যেখানে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা দিবস পালন করা হয় না৷ পরবর্তী সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ভাষা দিবস পালন করা হয়৷
পর্নোগ্রাফি দেখার কারণে আমাদের শিশুদের কী পরিমাণ সামাজিক, শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হচ্ছে?
পর্নোগ্রাফি দেখার মানসিক প্রস্তুতি শিশুদের থাকে না৷ এসব দেখলে সারাক্ষণ তাদের মাথায় তা ঘুরতে থাকে, কোনো কাজে বা পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে না৷ ফলে তাদের মানসিক মনোবৈকল্য দেখা দেয়, ব্যাহত হয় সুস্থ, স্বাভাবিক বিকাশ৷ আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, শিশু বয়সে পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে পরবর্তীতে তার স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক নিয়ে ধারণা ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়৷ শিশুটি বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত হতে পারে৷ এমনকি সামাজিকভাবে অপরাধেও জড়িয়ে পড়তে পারে৷
আপনাদের কাছে কি এমন রোগী আসে?
চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমি নিজেই পর্নোগ্রাফি দেখে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছে এমন রোগী পেয়েছি৷ সর্বশেষ ১২ বছরের একটি কিশোর স্কুলে বন্ধুর মাধ্যমে প্রথম পর্নোগ্রাফি দেখে৷ এরপর তার আগ্রহ বেড়ে যায়৷ এক পর্যায়ে সে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ে৷ এর ফলে তার স্বাভাবিক লেখাপড়া দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ পরে ওই কিশোর সামাজিক অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে৷ এ সব কারণে তার স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়৷ একটা সময় তার অভিভাবকরা আমার কাছে তাকে নিয়ে এসেছিলেন৷ আসলে তরুণ ও কিশোরদের এ ব্যাপারে ‘ওরিয়েন্টেশন' দরকার৷
শিশু পর্নোগ্রাফি আমাদের দেশে যেমন আছে, উন্নত দেশেও আছে৷ তারা তো এটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় না৷ আমাদের মতো দেশে কেন তাহলে এ নিয়ে এত হৈচৈ হয়?
শিশু পর্নোগ্রাফি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেমন নিষিদ্ধ, বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ৷ এর বিরুদ্ধে ঐ সব দেশেও আইন আছে, আমাদেরও আছে৷ পর্নোগ্রাফিতে শিশুদের ব্যবহার করা সেই সব দেশেও অপরাধ, আমাদের দেশেও অপরাধ৷ এমনকি আমাদের দেশে এটা একটা ফৌজদারি অপরাধ৷ আমাদের সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে৷ জনসচেতনতা তৈরি করতে কাজ করছে৷ আমরা চাই, আমাদের শিশুরা সুস্থভাবে বেড়ে উঠুক৷
শিশু পর্নোগ্রাফি পুরোপুরি মুক্ত করতে হলে সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার? এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী?
আমাদের বাচ্চাদের খেলার মাঠ নেই, সাংস্কৃতিক কোনো কর্মকাণ্ড নেই৷ শিশুদের জন্য সুস্থ বিনোদনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে আমাদেরই৷ বাচ্চাদের খেলার মাঠ দিতে হবে৷ সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরি করতে হবে৷ ধর্মীয় মূল্যবোধ এখানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ শিশুদের যদি ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী করে বড় করা যায়, তাহলে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতাও কমে যাবে৷ তাহলে এই ধরনের অপরাধ নির্মূল সম্ভব বলে আমি মনে করি৷
এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷