পশ্চিমবঙ্গে বিনামূল্যে চিকিৎসার দিন শেষ?
৩০ অক্টোবর ২০২১পশ্চিমবঙ্গে এতদিন পর্যন্ত সরকারি চিকিৎসার সব সুযোগ-সুবিধা বিনামূল্যে পেতেন রোগীরা৷ এবার কি তবে সেই সুযোগ মিলবে না? স্বাস্থ্য দপ্তরের নতুন নির্দেশিকা ঘিরে সেই প্রশ্নই উঠছে৷ সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যসাথীসহ চারটি সরকারি হেলথ কার্ড বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ কার্ড না থাকলে সরকারি হাসপাতালে তৈরি করে দেয়া হবে কার্ড৷ এমনই নির্দেশিকা জারি করেছে স্বাস্থ্য দপ্তর৷
চিকিৎসকদের সংগঠনগুলি নতুন নির্দেশিকার বিরুদ্ধে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন৷ ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম-এর সদস্য ডাঃ অর্জুন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে জনগণের করের টাকায়৷ যাদের করের টাকায় এই পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে, তাদের সরাসরি সুযোগ থাকা দরকার৷’’
দেশে চিকিৎসা পরিষেবায় যে টাকা খরচ হয়, তার প্রায় ৭০ শতাংশ হয়ে থাকে আউটডোর চিকিৎসায়৷ ডাক্তার দেখানো, পরীক্ষা আর ওষুধ কিনতেই বেশি টাকা খরচ হয়৷ স্বাস্থ্যসাথী বা আয়ুষ্মান ভারতের মতো কোনো প্রকল্পে এই টাকা পাওয়া যায় না৷ সমীক্ষা অনুযায়ী, এই পরিমাণ টাকা মেটাতে গিয়েই প্রতি বছর সাত কোটি ভারতবাসী দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যাচ্ছেন৷ কাজেই চিকিৎসকদের সংগঠনগুলির দাবি, স্বাস্থ্যসাথী বা যেকোনো বিমাভিত্তিক প্রকল্পে সরকার যে টাকা বরাদ্দ করে, সেই টাকায় পরিকাঠামো আরও ভাল করে তোলা যেত৷ সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের সম্পাদক ডাঃ সজল বিশ্বাস বলেন, ‘‘এই ধরনের হেলথ কার্ডের মাধ্যমে সাধারণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে৷ কার্ড ব্যবহার করে চিকিৎসায় যে জটিলতা সৃষ্টি হবে, তাতে বেশিরভাগ মানুষই উতরোতে পারবেন না৷ সরকার জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর নিয়ে বিমা কোম্পানিকে না দিয়ে নিজস্ব স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটাতে কাজে লাগালে ভালো হত৷’’
স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে পরিবার পিছু পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ৷ এর মধ্যে বিমা কোম্পানি দেয় দেড় লক্ষ টাকা৷ আর বাকি সাড়ে তিন লক্ষ টাকা স্বাস্থ্য ভবন থেকে দেওয়া হয়৷ সেই টাকা ফুরিয়ে গেলে কী হবে? চিকিৎসক মহল বেশ কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছেন৷ পাঁচ লক্ষ টাকা ফুরিয়ে গেলে রোগী কি সরকারি হাসপাতালে পরিষেবা পাবেন না? তখন চিকিৎসার খরচ কীভাবে চলবে, বিনামূল্যে নাকি টাকা দিয়ে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো পরিষ্কার করে জানা নেই কারও৷ শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের সদস্য ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ বলেন, ‘‘এই যে বিমার কথা বলা হচ্ছে, তা কেবল ইনডোর হাসপাতালের খরচ বহন করে৷ তাছাড়া বিমা সংস্থা খরচ হওয়া টাকার সবটা দেয় না৷ কিছুটা অংশ দেয়৷ বাকি অংশটা মানুষকে নিজের পকেট থেকেই দিতে হবে৷’’
যদিও স্বাস্থ্য দফতরের কর্মকর্তাদের যুক্তি, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কত খরচ হচ্ছে, সেই হিসেব পেতেই এই নির্দেশিকা৷ কিন্তু এতে সন্তুষ্ট নন বড় অংশের চিকিৎসকেরা৷ আদতে এটা সরকারি পরিষেবাকে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দেওয়ার উদ্যোগ, সেটা অনেকেই মনে করছেন৷ ডাঃ দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘আমি মনে করি, সরকার নাগরিকদের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব থেকে হাত তুলতে শুরু করেছে৷ বেসরকারি বিমার হাতে তুলে দিচ্ছে সেই দায়িত্ব৷ এটাই প্রথম ধাপ৷ পরের ধাপে এটাকে জনপ্রিয় করে তোলা হবে৷’’
জনগণ এবং সরকারের মধ্যে হঠাৎ বিমা কোম্পানির অনুপ্রবেশকে ভাল চোখে দেখছেন না ডাঃ বিশ্বাস৷ তিনি বলেন, ‘‘স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের যে প্রিমিয়াম আজ সরকার দিয়ে দিচ্ছে, সেটা ভবিষ্যতে মানুষকে দিতে হতে পারে৷ আর জনগণের করের টাকা বিমা কোম্পানিকে কেন দেওয়া হবে? এই স্বাস্থ্য পরিষেবা, পরিকাঠামো তো বিমা কোম্পানি চালাচ্ছে না৷ তা হলে সাধারণ মানুষের টাকা হঠাৎ তাদের দেওয়া হবে কেন?’’
মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক ডাঃ অংশুমান মিত্র বলেন, ‘‘গত ২৫-৩০ বছর ধরে চলে আসা, সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবাকে বন্ধ করার উপক্রম করেছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার৷ ধাপ ধাপে পেইড চিকিৎসা বাড়ানো, ফ্রি আউটডোর চিকিৎসা কমিয়ে দেওয়া, পেয়িং বেড বাড়ানো, ওষুধের খরচ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে পাবলিক মানি প্রাইভেট পকেটে যাওয়া শুরু করেছে৷ এবার স্বাস্থ্য পরিষেবাকে পুরো ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করেছে৷’’