পাকিস্তানে উগ্রপন্থীদের প্রভাব – হাইনরিশ বোল ফাউন্ডেশনের দৃষ্টিকোন থেকে
২৮ মার্চ ২০১১গত কয়েক বছরে পাকিস্তানে উগ্রপন্থীদের সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনকহারে৷ গত ত্রিশ বছরে কয়েক হাজার মাদ্রাসার ছাত্রের মধ্যে পশ্চিম বিরোধী মনোভাবে তৈরি করা হয়েছে৷ এদের মূল লক্ষ্য দেশে ধর্ম নিরপেক্ষতা নয় বরং ধর্ম নিয়ন্ত্রিত শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা৷ কয়েক বছরে বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী দল পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালিয়েছে৷ পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা দপ্তর আইএসআই বিশ্বাস করে এদের সঙ্গে তালেবানদের গভীর যোগাযোগ রয়েছে৷ সম্প্রতি পাকিস্তানের গভর্নর সালমান তাসিরের হত্যাকান্ডের পর সাধারণ মানুষ এই হত্যাকান্ডকে সমর্থন করেছে৷ সালমান তাসির ব্লাসফেমি আইনের বিরোধীতা করেছিলেন৷ ডয়েচে ভেলের সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেছেন গ্রেগর এনস্টে৷ সাক্ষাৎকারটি তুলে দেয়া হল:
প্রশ্ন: আপনি পাঁচ বছর পাকিস্তানে কাটিয়েছেন৷ দেশটির সামনে কোন ধরণের ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে?
উত্তর: এর সঠিক কোন উত্তর আমার কাছে নেই৷ আমি শুধু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে এটুকু বলতে পারি যে, পাকিস্তানের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে৷ দেশটি এগিয়ে যাচ্ছে ভুল পথে৷ তবে পুরোপুরি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না যেমনটি করে আহমাদ রশিদ তাঁর বইয়ে লিখেছেন৷ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু ধর্মীয় উগ্রপন্থী এবং সন্ত্রাসী ঘেরা একটি সমাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান৷ যে সমাজের উদারপন্থীদের স্থান খুবই কম, খোলা মনের চিন্তা-ভাবনা, মন মানসিকতা পুরোপুরি অনুপস্থিত থাকবে৷
প্রশ্ন: সালমান তাসিরের হত্যাকান্ডে জনসাধারণ মনোভাব দেখে আপনার কী মনে হয়েছে ?
উত্তর: আমি অবাক হয়েছি, ভীষণ অবাক হয়েছি৷ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এবং শিক্ষিত মহল যেভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে৷ আমি যা দেখেছি তা হল, লাহোরের মত স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উগ্রপন্থীদের পক্ষে কন্ঠ শোনা যাচ্ছে৷ তাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ যা একটি দেশের জন্য কখনোই শুভকর নয়৷ এটা ভয় পাওয়ার মত বিষয়৷ দুই বছর আগে যেখানে দেশের আইনজীবীরা সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য – সেটা ছিল আশার আলোর, শুভ লক্ষণ৷ সেখান থেকে ছিটকে পড়েছে পাকিস্তান, এগিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার যুগের দিকে৷ এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য যে, যেসব আইনজীবীরা দেশের আইনের শাসন কায়েম করতে চেয়েছিলেন, যারা দেশের সম্ভ্রান্ত স্তরের, উচ্চ শ্রেণীর বলে মনে করেন, যারা গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের জন্য লড়বেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তারাই সালমান তাসিরের খুনীদের সমর্থন করেছেন৷ তারাই গোলাপের পাপড়ি দিয়ে হত্যাকারীদের সংম্বর্ধণা জানিয়েছেন৷
আমার জন্য তা ছিল এককথায় অবিশ্বাস্য৷ আমি পাঁচ বছর পর পাকিস্তান থেকে একজন বন্ধু হিসেবে ফিরে এসেছি৷ আমি একাই একজন শুভাকাঙ্খি৷ আমার জন্য এসব ছিল বিশাল একটি ‘শক'৷ আমি পাকিস্তানের সমাজকে শেষের দিকে আর বুঝতে পারিনি৷
প্রশ্ন: আপনার কী মনে হয় পাকিস্তান সরকার ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের প্রতিহত করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে?
উত্তর: না, একেবারেই না৷ এবং আমার ধারণা সত্যিকার অর্থে যে বা যারা দেশের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিহত করার সময় এখন আর নেই, অনেক দেরী হয়ে গেছে৷ পাকিস্তানের শত্রু পাকিস্তানের ভেতরের তরুণ প্রজন্ম৷ যাদের বোঝানো হয়েছে আসল শত্রু হচ্ছে পশ্চিমী বিশ্ব৷ সন্ত্রাসীদের খুবই ছোট একটি দল নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের তরুণ প্রজন্মের বিশাল একটি সংখ্যাকে৷ এবং পাকিস্তানের সরকার যা করছে তা কোন অবস্থাতেই যথেষ্ঠ নয়৷ একটি উদাহরণ দিচ্ছি,গত বছর আমি যখন লাহোরে কাজ করছিলাম, কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি লক্ষ্য করছিলাম, যে বিভিন্ন ধরণের ব্যানার রাস্তার মোড়ে মোড়ে, সুপার মার্কেটে ঝুলছে৷ সেখানে লেখা আহমাদিদের পরিত্যাগ করতে, বিধর্মীদের পরিত্যাগ করতে, বয়কট করতে৷ আরো বলা হচ্ছে আহমাদিদের ‘হত্যা' করতে৷ পাকিস্তানের সব সর্বনাশের জন্য এরা দায়ী তাও লেখা ছিল ব্যানারে৷ এধরণের ব্যানার লাহোরের মত শহরে রাত-দিন ঝুলছে তা মেনে নিয়েছিল লাহোর শহর কর্তৃপক্ষ৷ পাকিস্তান মেনে নিয়েছিল৷ কোন অবস্থাতেই সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না৷ আর এরপর কী হয়েছে? বোমা বিস্ফোরণ, আহামাদিদের মসজিদে হামলা, প্রায় ৭০ জন মানুষ মারা গেছে৷ এসব ঘটনাকে পাকিস্তানের সমাজ আর প্রচার মাধ্যমগুলো উস্কে দিয়েছে৷ এর প্রতিবাদ বা সামলোচনা করা হয়নি৷ আমি বলবো, নীরব থেকে এধরণের ঘটানাকেই সমর্থন জানানো হয়েছে৷
দ্বিতীয়ত: পাকিস্তানের গভর্নর প্রসঙ্গে ফিরে আসছি৷ সেই ঘটনার কয়েক মাস আগে শাবাহ শরীফ পাঞ্জাবের নির্বাচিত মন্ত্রী, এক ভাষণে তেহরিক-এ-তালিবানদের বাহবা দিয়েছেন৷ পাকিস্তানের তালেবানদের সমর্থন করেছেন৷ তিনি বলেছেন,‘‘ভাইয়েরা আমার, কেন তোমরা আমাদের ওপর হামলা চালাচ্ছো? দিনের শেষে আমরা সবাই একই দেশের বাসিন্দা৷ আমরা একই শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছি৷ আমরা রুখে দাঁড়াচ্ছি আমাদের পশ্চিম সীমান্তে অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে৷'' আমি এই ভাষণকে উগ্রপন্থীদের প্রতিহত করা বলবো না৷
আরেকটি ঘটনা হল, মুম্বই হামলার পর, যখন পরিস্কার করে জানা গেল যে পাকিস্তানের আইএসআই-এর মদত ছিল মুম্বই-এর হোটেলে হামলা চালনোর৷ এর পর কয়েক সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানে বিতর্ক শুরু হয়েছে ভারত-কেন্দ্রিক রাজনীতি নিয়ে, কীভাবে ভারতকে যোগ্য জবাব দেয়া যায় – ইত্যাদি, ইত্যাদি৷ আর ঠিক তখন নওয়াজ শরীফ বলেন,‘‘যখন আমারা উত্তর সীমান্তে সত্যিকার শত্রুদের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াবো, তখন তালেবানরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে৷'' তাই আমি বলছি যে, পাকিস্তান সরকার ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের প্রতিহত করতে যা করছেন তা ভীষণ দুর্বল৷ এত দুর্বলভাবে আর যাই হোক ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের থামানো সম্ভব নয়৷
প্রশ্ন: এর অর্থ হল, পাকিস্তানের উচ্চ শ্রেণীর ধারণা, ভারতের বিরুদ্ধে যদি কিছু করতে হয়, সবাই একসঙ্গে এধরণের ঘটনাকে সমর্থন করবে?
উত্তর: দুর্ভাগ্যজনক হলেও, উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, তারা সবই করতে রাজি, উগ্রপন্থীদেরও তারা সমর্থন করবে৷
প্রতিবেদন: গ্রাহাম লুকাস/অনুবাদ: মারিনা জোয়ারদার
সম্পদনা: ফাহমিদা সুলতানা