চাপের মুখে বাংলাদেশ
৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪বাংলাদেশে ‘ওয়ান কম্পোজিট মিলস' নামের একটি পোশাক কারখানার মালিক নাসির উদ্দিন মিয়াকেও গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে গত বছরের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা দুটি৷ তাঁর কারখানায় রয়েছে মোট তিন হাজার শ্রমিক৷ তিনি বললেন, ‘‘কারখানায় কাজ করার সময় গরমে শ্রমিকদের কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম আমি যখন দেখি, তখন আমার খুব খারাপ লাগে৷ তাই আমি পুরো কারখানায়ই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেছি, যাতে শ্রমিকদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়৷ আমিও যে একসময় দরিদ্র ছিলাম, সেকথা আমি ভুলে যাইনি৷''
নাসির উদ্দিন খুবই গর্বিত যে তাঁর কারখানার শ্রমিকদের জন্য তিনি বিনা খরচে চিকিৎসা প্রদান, মাতৃত্বকালীন ছুটি, বাচ্চাদের দেখাশোনার ব্যবস্থা, বাৎসরিক বোনাস, বিনা মূল্যে স্কুলের বই ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে পেরেছেন৷ তাছাড়া তাঁর পোশাক কারখানার চকচকে মেঝে, ‘ইমারজেন্সি এক্সিট' এবং ‘ফাস্ট এইড'-এর ব্যবস্থা থাকায় বিদেশি ক্রেতারাও খুব খুশি৷
জার্মানির অন্যতম ইন্টারনেটভিত্তিক কোম্পানি ‘ক্লিংগেল', ক্রীড়া সামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘উলস্পোর্ট' অথবা হিপি ঘরানার পোশাক প্রস্তুতকারী কোম্পানি ‘ডেসিগুয়াল' বা ‘পাউল আর স্মিথ' প্রতিবছরই বাংলাদেশে কমপক্ষে পাঁচ লাখের মতো পোশাকের অর্ডার দেয়৷ কাটা, সেলাই থেকে শুরু করে প্যাকেট করা পর্যন্ত সবই করা হয়ে থাকে ‘ওয়ান কম্পোজিট মিলস'-এর মতো বাংলাদেশি কারখানাগুলোতে৷
শুধু নাসির উদ্দিনই নন, বাংলাদেশের অনেক পোশাক কারখানার মালিকই এখন রাজধানী ঢাকার বাইরে কারখানা গড়ে তুলছেন৷ যেমন ঢাকার অদূরে গাজীপুরেই বাস করেন প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ৷ জাতীয় শ্রমিক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট আমিরুল হক আমির বলেন, ‘‘ঢাকার বাইরে অবস্থিত কারখানাগুলোতে রয়েছে পর্যাপ্ত জায়গা এবং সেখানে কাজের পরিবেশও তুলনামূলকভাবে ভালো৷''
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের সব পোশাক কারখানার অবস্থা ‘ওয়ান কম্পোজিট মিলস'-এর মতো নয়৷ গত বছর পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশানস-এ আগুন লাগার ফলে বহু শ্রমিককে জীবন দিতে হয়েছে৷ এর পরের দুর্ঘটনা রানা প্লাজা৷ পোশাক শিল্প কারখানা রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যায় অন্তত এক হাজার একশো পোশাক শ্রমিক৷ আর তারপর থেকেই বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কারখানার মালিকদের ওপর সারা বিশ্বের ক্রেতাদের বিশেষ নজর৷
এ সব দুর্ঘটনা সত্ত্বেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের চাহিদা কিন্তু সারা বিশ্ব কমেনি, বরং বেড়েছে৷ ৫২ বছর বয়সি নাসির উদ্দিন বিশ্বাসের সাথে বলেন, বিদেশি টেক্সটাইল ব্যবসায়ীদের আমাদেরকে প্রয়োজন, তা না হলে তাঁরা কোথায় তাঁদের পণ্য তৈরি করবেন? তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের চেয়ে স্থিতিশীল, মিয়ানমারের চেয়ে বাংলাদেশের টেক্সটাইল শাখা অনেক বেশি সংগঠিত, ফিলিপিন্সের চেয়ে কারখানাগুলো অনেক বড় এবং ভারতের চেয়ে অনেক সস্তা৷''
আন্তর্জাতিক চাপ ও পোশাক শ্রমিকদের প্রতিবাদের ফলে গত ডিসেম্বরে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩,০০০ থেকে বেড়ে ৫,৩০০ টাকা হয়েছে৷ পোশাক শ্রমিক সংগঠনের কর্মী নাজমা আক্তার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘যখন থেকে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয়েছে, ঠিক তখন থেকেই শ্রমিকদের বাড়ির মালিকরাও ওঁদের ঘর ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে৷''
স্বাভাবিকভাবেই, এ নিয়ে চিন্তিত নাজমা৷ তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেছিলেন৷ তবে আজকাল শিশুশ্রম আর আগের মতো একটা বড় সমস্যা নয়, বলেন নাজমা আক্তার৷ পোশাক শ্রমিকদের অধিকার, ছুটি, সময়মতো বেতন পাওয়া, খাওয়ার পানি – এ সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন নাজমা৷ এছাড়া তাঁর শ্রমিক সংগঠনের মাধ্যমে নারী কর্মী ও শ্রমিকরা তাঁদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারেন৷ বেতন, মাতৃত্বকালীন ছুটি ইত্যাদি দাবি নিয়ে তাঁরা কথা বলতে পারেন কারখানার মালিকদের সাথে৷
নাজমা আক্তারের কাছে অনেকেই আসেন, জানান তাঁদের কারখানার অব্যবস্থাপনার কথা৷ যেমন কারখানায় আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নেই, ‘ইমারজেন্সি এক্সিট' বন্ধ থাকে বা খুলে দেওয়ার কেউ নেই, মালামাল রাখার ঘরে যাওয়ার পথ খুবই সরু – এ ধরণের নানা সমস্যার কথা জানান তাঁরা৷
বাংলাদেশে কর্মরত জার্মান উন্নয়ন সংস্থা জিআইজেড-এর মাগনুস স্মিড জানেন, ‘‘বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আইনটির বাস্তবায়ন করাই হলো বিরাট চ্যালেঞ্জ৷ সেজন্য জিআইজেড ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন আইএলও একযোগে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার জন্য নিয়ন্ত্রণকারী বা পরিদর্শকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে৷ বাংলাদেশে মোট সাড়ে পাঁচ হাজার পোশাক কারখানার জন্য মাত্র ১৯ জন নিযন্ত্রণকারী ছিলেন৷ এবার এই সংখ্যা বাড়িয়ে ৪১ জন করা হবে বলে জানান মাগনুস স্মিড৷
জার্মান উন্নয়ন সংস্থা জিআইজেড এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন আইএলও বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তার জন্য একটি বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যাতে ইতিমধ্যেই স্বাক্ষর করেছে মোট ১০০টি প্রতিষ্ঠান৷ তাদের মধ্যে রয়েছে আডিডাস, লিডল, আলডি, এসপ্রি, কারস্টাট, কিক, মেট্রো, অটো, পুমা, রেভে, এস. অলিভার এবং চিবো৷
এনএস/ডিজি (ডিপিএ, রয়টার্স)