প্রাণ দিতে হলো ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বৌ’কে
৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩
শুধু সাহসী নন, অসমসাহসী বাঙালি লেখিকা ৪৯ বছরের সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় পাকটিকা প্রদেশের খারানা শহরের উপকণ্ঠে তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারলেন না৷ জঙ্গিরা রাতে তাঁকে ঘর থেকে টেনে বের করে গুলিতে ঝাঁজরা করে দেয়৷ তারপর কাছের এক মাদ্রাসার সামনে ফেলে রেখে চলে যায় তাঁর লাশ৷ পরে তাঁকে কবর দেয়া হয়৷ এই হত্যার জন্য তালিবানকে সন্দেহ করা হলেও তারা তা অস্বীকার করেছে৷ অনেকের সন্দেহ, সুস্মিতার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের হাত আছে এই হত্যার পেছনে৷
যারাই সুস্মিতাকে হত্যা করুক, হত্যার কারণ – সুস্মিতা তাঁর লেখায় তুলে ধরেছিলেন আফগান মেয়েদের ওপর অমানুষিক ব্যবহার, আফগান সমাজ জীবনের নানা অন্যায়-অবিচারের কথা৷ সেই রাগের শোধ তুলতেই এই হত্যা, জানান পাকটিকা প্রদেশের পুলিশ প্রধান৷
কলকাতায় এক আফগান ব্যবসায়ী জানবাজ খানকে সুস্মিতা বিয়ে করেছিলেন সকলের নিষেধ অগ্রাহ্য করে৷ বিয়ের পর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নাম নেন সায়েদ কামালা৷ মোহভঙ্গ হতে দেরি হয়নি সুস্মিতার৷ ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তানে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সেখানকার পারিবারিক তথা সামাজিক জীবন তাঁকে বিস্মিত ও বিধ্বস্ত করে দেয়৷
অসীম সাহসে ভর করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তালিবানের চোখ এড়িয়ে ১৯৯৪ সালে শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে ইসলামাবাদে পৌঁছলে তাঁর দেওর তাঁর পিছু ধাওয়া করে সুস্মিতাকে আবার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যায়৷ ভারতে ফেরত পাঠানোর আশ্বাস দিয়েও তা রাখেনি৷ সুস্মিতা তারপর থেকে গৃহবন্দি৷ কাবুলের ভারতীয় হাইকমিশনও এ ব্যাপারে সাহায্য করেনি৷ তালিবান তাঁকে নষ্ট চরিত্র বলে বদনাম দেয়৷ মৃত্যুদণ্ডের ভয় দেখায়৷
আবার পালাবার পথ চলে৷ পালাবার আগে সুস্মিতা স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে আফগান মেয়েদের চিকিৎসা করতেন৷ একদিন রাতের আঁধারে মাটির বাড়ির দেয়ালে গর্ত করে সুস্মিতা পালাতে গিয়ে আবার ধরা পড়ে যান তালিবানের হাতে৷ তালিবান তাঁকে জেরা করে সারারাত ধরে৷ নিজেকে ভারতীয় নাগরিক প্রমাণ করায় পরের দিন সকালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কাবুলের ভারতীয় হাইকমিশনে৷ সেখানে হাইকমিশন তাঁকে ভারতে পাঠাবার ব্যবস্থা করে৷ ফিরে আসেন উনি কলকাতায় আবার৷
শ্বশুরবাড়ি থেকে পালানোর রোমহর্ষক আখ্যান নিয়ে ১৯৯৫ সালে তিনি লেখেন ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বৌ’৷ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বেস্টসেলার৷ পরে ইংরেজি সংস্করণ বের হয়৷ ঐ কাহিনি নিয়ে বলিউডে ‘এসকেপ ফ্রম তালিবান’ ছবি তৈরি হয় ২০০৫ সালে৷ তারপর আফগানিস্তান নিয়ে একাধিক বই লেখেন৷ যেমন, ‘তালিবান, আফগান ও আমি’‘, ‘একবর্ণ মিথ্যা নয়’৷
অনেকেরই প্রশ্ন, জেনেশুনে নিজের অভিজ্ঞতার পরেও কেন তিনি আবার আফগানিস্তানে গেলেন নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে? এই দুঃসাহসের মধ্যে বিচক্ষণতার কি অভাব ছিল না? কেউ কেউ বলছেন, আফগান সমাজজীবন – বিশেষ করে নারীদের অবস্থা নিয়ে আরো লেখালেখির রসদ সংগ্রহ করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য৷ তবু বলতেই হবে সুস্মিতা বন্দোপাধ্যায় বাঙালি নারীদের ভীরু লবঙ্গলতা ভাবমূর্তিটাকেই দিলেন পালটে৷ তালিবানের গুলি পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইকে মারতে না পারলেও বাঙালি সুস্মিতাকে নারীমুক্তির লড়াই-এ জীবন দিতে হলো৷