বন্ধ যুক্তরাজ্যের বিমান, সমস্যায় যাত্রীরা
২৫ ডিসেম্বর ২০২০৩৬ বছরের সৌমিক সান্যাল গত ১৫ বছর কলকাতার একটি প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছেন। বেশ উচ্চপদেও পৌঁছেছিলেন। মাসখানেক আগে সৌমিক ঠিক করেন কাজ ছেড়ে আরো পড়াশোনা করবেন। সেই মতো চাকরি ছেড়ে এত দিনের জমানো টাকা খরচ করে লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে তাঁর। আগামী ৩০ ডিসেম্বর লন্ডনে উড়ে যাওয়ার কথা ছিল সৌমিকের। কিন্তু ২৩ তারিখ ভারত-যুক্তরাজ্য ফ্লাইট বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার। মাথায় হাত সৌমিকের। ১১ তারিখের মধ্যে লন্ডন পৌঁছতে না পারলে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে এনরোলমেন্টই হবে না।
যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন স্ট্রেইন ধরা পড়ার পরেই গোটা বিশ্বে আলোড়ন ছড়িয়েছে। এমনিতেই গত এক বছর ধরে করোনা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কম বেশি প্রায় সব দেশ। তারই মধ্যে যুক্তরাজ্যের নতুন স্ট্রেইন আরো ভয়াবহ। আগের চেয়ে অনেক দ্রুত ছড়াচ্ছে এই স্ট্রেইনের করোনা। যুক্তরাজ্যে হু হু করে বাড়ছে সংক্রমণ। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপের মতো ভারতও সিদ্ধান্ত নেয়, আপাতত যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হবে না। ওই দেশের স্ট্রেইনকে কোনো ভাবেই ভারতে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। যদিও তা আটকানো যায়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রকেরই একটি সূত্র ডিডাব্লিউকে জানিয়েছে, গোটা দেশে অন্তত ২০ জনের শরীরে ওই স্ট্রেইন পাওয়া গিয়েছে। তাঁরা সকলেই লন্ডন থেকে এসেছেন। এবং কেউই আইসোলেশনে নেই।
৩১ ডিসেম্বর মাঝরাত পর্যন্ত আপাতত যুক্তরাজ্যের ফ্লাইট বন্ধ করেছে ভারত। তবে পরিস্থিতি যা, তাতে সময়সীমা আরো বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। বস্তুত, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারত সরকার এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। সৌমিকের মতো আরো অনেকেই এর ফলে আটকে পড়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, সরকার যদি একটু সময় দিতো, তা হলেই তাঁরা টিকিট বদলে নিতে পারতেন। এই সমস্যায় পড়তে হতো না।
তথ্য বলছে, প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় যুক্তরাজ্যের টুরিস্ট ভিসা পান। ৫৬ হাজার ভারতীয় কর্মী প্রতি বছর যুক্তরাজ্যে কাজ করতে যান। এবং ২০ থেকে ৩০ হাজার ভারতীয় প্রতি বছর যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করতে যান। ফলে সব মিলিয়ে প্রায় ছয় লাখ ভারতীয় প্রতি বছর বিভিন্ন প্রয়োজনে যুক্তরাজ্যে যান। গত এক বছরে এই সংখ্যাটায় ব্যাপক হ্রাস হয়েছে। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে ভারতে লকডাউন শুরু হয়। যুক্তরাজ্য সহ গোটা পৃথিবীর সঙ্গেই বিমান যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কেবলমাত্র এয়ার ইন্ডিয়ার বিশেষ ফ্লাইট বন্দে ভারতে বিদেশে আটকে পড়া ভারতীয়দের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ফলে ছয় মাসে মাসে দেশের কোনো ব্যক্তি বিদেশে যেতে পারেননি। সেপ্টেম্বর থেকে ফের বিদেশে বিমান যেতে শুরু করে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও যোগাযোগ শুরু হয়। যাতায়াত আবার স্বাভাবিক হচ্ছিল। তার মধ্যেই নতুন করে ফ্লাইট বন্ধ হওয়ায় সমস্যায় পড়েছেন অনেকে।
কলকাতা বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, প্রতি সপ্তাহে ভারত এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে ৪৫টি ফ্লাইট সরাসরি যাতায়াত করে। অর্থাৎ, ৪৫টি ফ্লাইট ভারত থেকে যুক্তরাজ্য যায় এবং আবার সেখানে থেকে ফেরে। এর মধ্যে ব্রিটিশ এয়ারলাইন্স, এয়ার ইন্ডিয়া, ভিস্তারা, এমিরেটসের মতো বিমান সংস্থার ফ্লাইট আছে। আগামী এক সপ্তাহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রায় সবকটি ফ্লাইটের বুকিং ফুল ছিল। আচমকা বিমান পরিষেবা বন্ধ হওয়ায় সংস্থাগুলির বিপুল ক্ষতি হয়েছে। বস্তুত, লকডাউনের সময় বেশ কয়েকটি বিমান সংস্থা বিদেশের ফ্লাইট বন্ধ করে দেবে বলেও ভাবনাচিন্তা করছিল। ক্ষতির বোঝা তারা আর টানতে পারছিল না।
বাণিজ্য ক্ষতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য হয়। যার মধ্যে ভারত যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করে সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জিনিস। আর আমদানি করে তিন দশমিক চার বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামগ্রী। গত এক বছরে এই বাণিজ্যও ভয়াবহ রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বস্তুত, সার্বিক ভাবেই ভারতের বাণিজ্য এই এক বছরে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছে। নভেম্বরের রিপোর্ট সব মিলিয়ে প্রায় নয় শতাংশ ক্ষতি হয়েছে ভারতীয় বাণিজ্যের। আগামী কয়েক মাসে যা আরো বাড়তে পারে। তবে নভেম্বর থেকেই নতুন করে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ শুরু করেছিল ভারত। যুক্তরাজ্যের ঘটনা ফের অনিশ্চয়তা তৈরি করল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যোগাযোগ ছিন্ন করে বেশি দিন ভারতের পক্ষে বসে থাকা মুশকিল। ফলে বিকল্প ব্যবস্থা করতেই হবে।