মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়াতে পারে বাংলাদেশ
১৫ অক্টোবর ২০২০ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের (আইএমএফ)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে এসেছে৷ আইএমএফ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি চার শতাংশ বেড়ে হতে পারে এক হাজার ৮৮৮ ডলার৷ সেখানে ভারতের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ১০ দশমিক পাঁচ শতাংশ কমে হতে পারে এক হাজার ৮৭৭ ডলার৷ অর্থাৎ, এই প্রথম মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের থেকে ১১ ডলার এগিয়ে যেতে পারে৷
স্বাভাবিক ভাবেই আইএমএফ-এর এই রিপোর্ট নিয়ে ভারত জুড়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে৷ কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী টুইট করে বলেছেন, পাঁচ বছর আগেও যেখানে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি ছিল, সেখানে আইএমএফ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে যেতে পারে৷ মোদী সরকারের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার এটাই সবচেয়ে বড় উদাহরণ৷
আন্তর্জাতিক অর্থনীতি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক কৌশিক বসু বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন৷ একই সঙ্গে ভারতের সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন৷ বস্তুত, এর আগেও ভারতের চলতি অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একাধিকবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কৌশিকবাবু৷
বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর করোনাকালে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থান নিয়ে কথা বলেছেন ডয়চে ভেলের সঙ্গে৷ তিনি বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং আইএমএফ-এর সাবেক কর্মকর্তা৷ মূলত তিনটি বিষয়কে তিনি বাংলাদেশের সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন৷ এক, সরকারি হিসাবকে ঠিক ধরে নিলে যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল বাংলাদেশ করোনা পরিস্থিতি ততটা প্রকট হয়নি৷ সে কারণে অর্থনীতিতেও অন্যদেশের মতো করোনার প্রভাব সেভাবে পড়েনি৷ দুই, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক খুব দ্রুতই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে৷ শুরুর দিকে রপ্তানি আদেশ বাতিল করলেও ব্যবসায়ীদের সংগঠন এবং সরকারিভাবে দ্বিপাক্ষিক চাপের মাধ্যমে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে আবারও পণ্য নিতে শুরু করেছে৷ যার কারণে এরিমধ্যে সার্বিক রপ্তানি ৮০ ভাগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে৷
ড. মনসুর আশা করছেন, আগামী বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশের রপ্তানি পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে৷ আর বছরের শেষ অধ্যায়ে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে আসবে বলে তার ধারণা, যদি না করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সমস্যা তৈরি করে৷ বাংলাদেশের সরকার চলতি ২০২০-২১ অর্থ বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আট শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে৷ সেটি না হলেও তিন থেকে চার শতাংশ বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি৷ আইএমএফ-এর রিপোর্টেও তাই বলা হয়েছে৷ বর্তমান পরিস্থিতির বিবেচনায়ও এই প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট ভালো৷ রপ্তানির পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাড়ানোর তৃতীয় কারণটি রেমিট্যান্স৷ করোনার মধ্যেও বাংলাদেশের প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়েছেন দেশে৷ যা অর্থনীতিকে যা সচল রাখতে সাহায্য করেছে৷
অন্যদিকে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারত সে তুলনায় ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন আহসান মনসুর৷ সেই সঙ্গে মোদী সরকারের জাতীয়তাবাদী এবং সামাজিক নীতি ভারতের অর্থনীতিকে অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে৷ বস্তুত, এই ক্ষেত্রে রাহুল গান্ধীর বক্তব্যের সঙ্গে তার ব্যাখ্যা মিলে যাচ্ছে৷
ভারতের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক দীপঙ্কর দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘মাথাপিছু জিডিপি নিয়ে যে আলোড়ন তৈরি হয়েছে, অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি তা নিয়ে খুব মাথা ঘামাচ্ছি না৷ কারণ, ভারত এবং বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি নিয়ে কোনো তুলনাই চলে না৷ ভারতের জনসংখ্যা অনেক বেশি৷ জিডিপির সামান্য হেরফেরে মাথাপিছু জিডিপির অনেকটা তফাত হয়ে যায়৷ আইএমএফ-এর রিপোর্টই বলছে, ২০২১-২২ আর্থিক বছরে ভারতের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি আট দশমিক দুই শতাংশ বেড়ে দুই হাজার ৩০ ডলার হবে৷ সেখানে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি পাঁচ দশমিক চার শতাংশ বেড়ে এক হাজার ৯৯০ ডলার হবে৷''
দীপঙ্করবাবুর মতে, ভারতের অর্থনীতির অবস্থা মোটেই খুব আশাপ্রদ নয়৷ চলতি আর্থিক বছরের প্রথম অধ্যায়ে ২৩ শতাংশের বেশি জিডিপির পতন হয়েছে৷ করোনাকালে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের জিডিপির পতন হয়েছে৷ কিন্তু ভারতের যে হারে পতন হয়েছে তা বিস্ময়কর৷ ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ালেও চলতি অর্থ বছরে ভারতের জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ পতন হবে৷ এর থেকে পরিষ্কার, মোদী সরকারের আমলে ভারতের অর্থনীতি যথেষ্ট খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে৷ সার্বিক ভাবে অর্থনীতি সমস্যার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে৷ তবে বাংলাদেশের মাথা পিছু জিডিপির সঙ্গে ভারতের তুলনার বিষয়টিতে আপত্তি আছে দীপঙ্করবাবুর৷ তার মতে, অর্থনীতির এককে এ ধরনের তুলনা বিজ্ঞানসম্মত নয়৷
চলতি বিতর্কে মুখ খুলেছে ভারত সরকারও৷ বৃহস্পতিবার সরকার রাহুল গান্ধীর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জানিয়েছে, রাহুল আইএমএফ-এর রিপোর্টের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করে সংকীর্ণ রাজনীতি করছেন৷ আইএমএফ-এর রিপোর্ট বলছে, ২০২০ সালে ভারতের মাথাপিছু পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) ছয় হাজার ২৮৪ ডলার৷ বাংলাদেশের পাঁচ হাজার ১৩৯ ডলার৷ এই হিসেবটি বিরোধীরা দিচ্ছেন না৷ শুধু তাই নয়, ২০২১-২২ সালে ভারতের জিডিপির আট দশমিক আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলেও আইএমএফ জানিয়েছে৷ এই পরিস্থিতিতে যা যথেষ্ট বড় সাফল্য৷ অর্থাৎ, কোভিড সমস্যা কাটিয়ে ভারতীয় অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে৷
বিতর্ক ছিল, আছে এবং থাকবে৷ তবে অধিকাংশ অর্থনীতিবিদের মতে কোভিড সময়ে দাঁড়িয়েও বাংলাদেশ অর্থনীতিকে যেভাবে ধরে রাখতে পেরেছে তা অভিনদন পাওয়ার মতোই৷ ভারতীয় অর্থনীতি যে সমস্যার মুখে পড়েছে, তাও এক কথায় মেনে নিতেই হয়৷ সেখানে করোনাকে একমাত্র কারণ বলে মনে করলে সত্যের অপলাপ হবে৷ তবে এ কথাও ঠিক, করোনা এবং লকডাউনের কারণে ভারতীয় অর্থনীতি যে বড় রকমের হোঁচট খেয়েছিল, সেখান থেকে তা ইতিমধ্যেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে৷