বন্ধ হচ্ছে না বাল্যবিয়ের অভিশাপ
৫ ডিসেম্বর ২০১৪এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে খবর পেয়ে উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লোকমান হোসেন এই বিবাহ বন্ধ করে দেন৷ লোকমান হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, আমদিয়া এলাকার ১৪ বছর বয়সি এক ছাত্রীর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী হামকুর এলাকার সালাম মিয়ার ছেলে মালয়েশিয়া ফেরত শাহীন মিয়ার বিয়ের খবর তিনি গ্রামের একজনের মাধ্যমে জানতে পারেন৷ এরপর দ্রুত স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিয়েটি বন্ধও করে দেন৷
লোকমান হোসেনের তত্পরতায় রূপগঞ্জের এই বাল্যবিয়েটি বন্ধ হলেও প্রশাসনের অজান্তেই কিন্তু অহরহ গ্রামগঞ্জে বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশে৷ সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণেই অভিভাবকরা মেয়েকে আগে-ভাগে বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করতে চান৷ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের এক হিসেবে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি৷ শতকরা ৬৫ ভাগ৷ বিশ্বে বাল্যবিয়ের দিক দিয়ে বাংলাদেশ চতুর্থ বলে ব্র্যাকের ঐ হিসাবে দেখা গেছে৷ সরকারি-বেসরকারি তত্পরতার মধ্যেও এই হার যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিকভাবে সচেতনা ছাড়া এই হার কমানো যাবে না৷
ব্র্যাকের সিনিয়র স্পেশালিস্ট কাজি শাহানার মতে, দারিদ্রতা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণেই অধিকাংশ বাবা-মা তাঁদের মেয়েকে অপ্রাপ্ত বয়েসেই বিয়ে দিয়ে দেন৷ তাঁরা মনে করেন, যত দ্রুত মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবেন ততই তাঁর মেয়ের জন্য মঙ্গল৷ আর তাঁরাও মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হয়েছেন বলে মনে করেন৷
রূপগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, যে বিয়েটি তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের একটি ভুয়া জন্মসদন দিয়ে ওই শিশুটির বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল৷ পরে তিনি উভয় পরিবারের কাছ থেকে এই বিবাহ না দেয়ার জন্য লিখিত একটি অঙ্গীকারানামা নেন৷ সেখানে তাঁরা অঙ্গীকার করেন, যদি পূর্ণ বয়সের আগে মেয়ের বিবাহ দেয়া তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ এছাড়া উভয় পরিবারের লোকজন এই বিবাহ দেবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দেন৷ তার সঙ্গে উপস্থিত স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরীফ আহাম্মেদ টুটুল দাবি করেন, ওই স্কুল শিক্ষার্থীকে জন্মসনদপত্র তিনি দেননি৷
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, শুধু দারিদ্রতা আর নিরাপত্তাহীনতাই নয়, এর সঙ্গেও আরো কিছু কারণ আছে৷ যেমন বিদেশ ফেরত কোনো পাত্র পেলে বাবা-মা ভালো পাত্র বলে মনে করেন আর মেয়ের পরবর্তী জীবনের কথা না ভেবেই তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন৷ আবার শহরেও অনেক শিশু বা কিশোরী প্রেমের কারণে পালিয়ে বিয়ে করছে৷
এলিনা খানের মতে, ‘‘আমাদের স্কুল ও কলেজে বাল্য বিয়ে নিয়ে আরো প্রচারণামূলক পড়ালেখা প্রয়োজন৷ কারণ স্কুল বা কলেজ থেকে মেয়েরা যদি জানতে পারে যে অল্প বয়সে বিয়ের কারণে সে ভবিষ্যতে আরো কয়েকটি বড় ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছে, তাহলে তারাও বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে এগিয়ে আসবে৷ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ১৪ বছর বয়সে একটি মেয়ের বিয়ে হওয়ার পর ১৮ বছরের মধ্যেই হয়ত সে দুই সন্তনের মা হয়ে গেল! এরপর যদি তার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয় তাহলে সে বাকি জীবনটা কিভাবে পার করবে? আবার অল্প বয়সি মায়েদের সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যুর হারও অনেক বেশি৷
গত ২৭শে নভেম্বর রাজশাহীর পবা উপজেলায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেয়েছে আরেক কিশোরী৷ ওই দিন উপজেলার হরিয়ান পূর্বপাড়া গ্রামে ১২ বছর বয়সি স্কুলপড়ুয়া এক কিশোরীর বিয়ে দেয়ার সময় উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (এসিল্যান্ড) শাহাদত হোসেন কবির বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বিয়ে বন্ধ করে দেন৷ পাশাপাশি তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে কোনোভাবেই যেন মেয়েটিকে বিয়ে দেয়া না হয়, তা নিশ্চিত করা এবং যে কোনো মূল্যে মেয়েটির পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অভিভাবকদেরকে নির্দেশ দেন৷
শাহাদত হোসেন কবির বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের বিষয়টিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে৷ ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দামকুড়া ইউনিয়নের ভীমের ডাইং ও আলোকছত্র গ্রাম দু'টিকে বাল্যবিবাহমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে৷ বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে উপজেলাকে মুক্ত করতে তার এই প্রয়াস৷