ব্লগারদের পাশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬গত রবিবার ‘বাংলাদেশ সংহতি বইমেলা' শিরোনামের আয়োজনটি করে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন দ্য হেগ পিস প্রজেক্ট এবং মুক্তমনা ব্লগ৷ তাদের সহায়তায় ছিল ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিস্ট অ্যান্ড এথিকাল ইউনিয়ন (আইএইচইইউ)৷ গত বছর ঢাকায় অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলাকালে খুন হন মানবতাবাদী লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়৷ মূলত এই লেখকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণে হেগে বইমেলা এবং ব্লগার ও মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যকার আলোচনার আয়োজন করা হয়৷
‘দ্য হেগ পিস প্রজেক্টের' পরিচালক জেকব ডে জঞ্জ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘হেগের আয়োজনের মাধ্যমে আমরা বোঝাতে চেয়েছি যেসব ব্লগার, লেখক সম্প্রতি বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন তারা একা নন৷ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অনেকেই আছেন, যারা তাদের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জানায়৷ এবং বাংলাদেশে চলমান ঘটনাবলী নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা৷''
ডে জঞ্জ বলেন, ‘‘বাংলাদেশে (ব্লগারদের নিয়ে) যা হচ্ছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ আমরা বর্তমান পরিস্থিতি পরিবর্তনে যা কিছু সম্ভব করবো৷''
নির্বাসনে অন্তত ২৮ ব্লগার
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের পর আরো তিন মুক্তমনা ব্লগার এবং এক সেক্যুলার প্রকাশক খুন হয়েছেন৷ তাদের হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে উগ্র ইসলামপন্থি একাধিক গোষ্ঠী৷ এ সব হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে বেশ কয়েকজন ব্লগার এবং প্রকাশক গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ ত্যাগ করে নির্বাসনে চলে যেতে বাধ্য হন৷ হেগের বিকল্প বইমেলায় আসা ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন জানান, ইতিমধ্যে কমপক্ষে ২৮ জন ব্লগার দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন৷ কেউ কেউ পরিবারসহ চলে এসেছেন৷ এদের অধিকাংশই অবস্থান করছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে৷
মহিউদ্দীন বলেন, ‘‘আরো অন্তত ৪০ জন ব্লগার বাংলাদেশে ভয়ে, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন৷ তারাও যে কোনো সময় দেশত্যাগে বাধ্য হতে পারেন৷ এছাড়া পরিস্থিতি না বদলালে আরো অনেকে বাংলাদেশ ছাড়ার চিন্তা করতে পারেন৷''
সরকারের উপর ‘চাপ প্রয়োগের' উদ্যোগ
হেগে আলোচনায় অংশ নেয়া আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিরা মনে করেন, যেসব ব্লগার নিজদেশে প্রাণভয়ে রয়েছেন, তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া উচিত৷ এ জন্য নির্বাসিত ব্লগার, লেখক এবং প্রবাসীদের নিয়ে সম্মিলতভাবে কাজ করার দিকে মত তাদের৷ পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ব্লগার, লেখকদের বাকস্বাধীনতা রক্ষা যে বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব তা নিয়ে আলোচনার পক্ষে তারা৷
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্যাম্পেইনার অওরা ফ্রিম্যান বলেন, ‘‘বাকস্বাধীনতা রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে৷ কিন্তু আমরা দেখছি, গতবছর কিংবা আরো লম্বা সময় ধরে যারা বাকস্বাধীনতার চর্চা করছেন, তাদের উপর হামলা চালানো হচ্ছে৷''
লন্ডনে বসবাসরত ফ্রিম্যান মনে করেন, বাংলাদেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা রক্ষায় আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জাতিসংঘের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছে৷ সম্ভব হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সরকার প্ল্যাটফর্ম, বিশেষ করে যেসব জায়গা থেকে চাপ প্রয়োগ সম্ভব বলে আমরা মনে করি, ব্যবহারের চেষ্টা করা হবে৷''
ব্লগার এবং মানবাধিকার কর্মীদের আলোচনায় অংশ নেয়া আইএইচইইউ-র পরিচালক বব চার্চিল জানান, বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের দায়ে গ্রেপ্তারের আইন রয়েছে যা নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ রয়েছে৷ আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, ধর্ম নিয়ে, ধর্মীয় দল এবং সংগঠন নিয়ে আলোচনা মানুষের অধিকার৷
নাস্তিক মানেই ‘মন্দ কিছু নয়'
হেগে বইমেলায় ব্লগার এবং মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে নাস্তিকতা সম্পর্কে একটি তীব্র নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে৷ মূলত উগ্র ইসলামপন্থিরা এই মনোভাবে কাজে লাগাচ্ছে, যাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল৷ চার্চিল এই বিষয়ে বলেন, ‘‘নাস্তিক শব্দটিকে নেতিবাচকভাবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে৷ অথচ এটি শুধু একটি প্রশ্নের উত্তরে ব্যক্তির অবস্থান৷ সেটা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা আছে নাকি নেই৷''
তিনি বলেন, ‘‘নাস্তিকতা নতুন কিছু নয়৷ অনেক রকমের নাস্তিক রয়েছেন৷ কেউ কেউ মনে করেন, ধর্ম তাদের কাছে কোন গুরুত্ব বহন করে না৷ কেউ কেউ আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলেন, ধর্মের নামে যা কিছু হচ্ছে তা ঠিক নয়৷ সেগুলো প্রতিরোধের প্রয়োজন মনে করেন তারা৷ আর এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, সব সমাজে আছে৷''
বাংলাদেশের বুঝতে হবে, ধর্মে অবিশ্বাসীরাও সমাজেরই অংশ এবং অনেক ভালো কাজে তাদের অবদান রয়েছে, বলেন চার্চিল৷
হেগে বইমেলায় বাংলা ভাষায় নতুন একটি ওয়েবসাইট তৈরির ঘোষণা দেন মুক্তমনা ব্লগের মডারেটর রাফিদা আহমেদ বন্যা৷ নতুন সাইটটি বিজ্ঞান, দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা বিশ্বকোষ হিসেবে কাজ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি৷ বর্তমানে সাইটটির কাজ চলছে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷