বিজয়ের মাসে, বিজয়ীদের কথা
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪পরে তাকে সিরাজগঞ্জের একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়৷
গত ৮ সেপ্টেম্বর বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম ওরফে ফারুক মোল্লার ছেলে শাওন মোল্লা প্রকাশ্যে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য আবদুর রশিদ মিয়াকে গালিগালাজ ও হেনস্তা করেন৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই বিষয়টিকে ‘নিন্দনীয়' ও ‘দুঃখজনক' বলে মন্তব্য করছেন৷ কিন্তু এই ঘটনা দু'টির কোনোটিতেই ‘আক্রমণকারীদের' বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷
গত বছরের বিজয়ের মাসের সঙ্গে চলতি বিজয়ের মাসের কোনো পার্থক্য দেখেন কিনা জানতে চাইলে ‘আমরা একাত্তর'-এর সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পার্থক্য তো পুরোটাই৷ এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ৷ বর্তমানে যে সরকার আছে, একটা অস্থায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তারা মুক্তিযুদ্ধটাকে রিসেট বাটন টিপে ভুলিয়ে দিতে চাচ্ছে৷ কাজেই সেটার জন্য যা যা পার্থক্য থাকার তার সব পার্থক্যই আছে৷''
বিজয়ের মাসে নেয়া সরকারের যেসব কর্মসূচি নিয়েছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘কর্মসূচি থাকা আর ওন (own) করার মধ্যে পার্থক্য আছে৷ মুক্তিযুদ্ধটা তো কোনো প্রোগ্রাম না৷ মুক্তিযুদ্ধ হলো ভাবাদর্শ, অস্তিত্বের প্রশ্ন৷ আপনি অস্তিত্ব স্বীকার না করে শুধু প্রোগ্রাম করলে তো আর হবে না৷''
বর্তমান সরকারের সময়ে যারা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন, তারা কেমন আছেন? মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের কারাগারে যেসব সুবিধা পাওয়ার কথা তারা কি তা পাচ্ছেন? সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় পদকপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে শাহরিয়ার কবীরকে ডিভিশন দিতে আদালত দুইবার নির্দেশ দিয়েছেন৷ কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ আদালতের নিদের্শনা মানছেন না৷ তাকে একটি ফ্লোরে অন্য কয়েদিদের সঙ্গে থাকতে হচ্ছে৷ পাশাপাশি তার কিডনির সমস্যা রয়েছে৷ তিনদিন আগে আমরা জানলাম তার তার প্রশ্রাব দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে৷ আদালত তার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিয়েছেন৷ কিন্তু সেটাও হচ্ছে না৷ সর্বশেষ তাকে গাজীপুর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে সারাদিন বসিয়ে রাখা হয়েছিল৷ সেখান থেকে কী রিপোর্ট পাওয়া গেছে সেটাও আমরা চেয়েছিলাম৷ কিন্তু দেওয়া হয়নি৷ ফলে তার চিকিৎসা যে সঠিকভাবে হচ্ছে না সেটা বোঝাই যাচ্ছে৷''
সাবেক মন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান নূর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে হেনস্থার শিকার হয়েছেন৷ শিক্ষার্থী পরিচয় দিয়ে কিছু মানুষ হাসপাতালে তাকে লাঞ্ছিত করেন৷ বর্তমানে সেখানেই চিকিৎসাধীন তিনি৷ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে রাজধানীর উত্তরায় এক ব্যবসায়ীকে ‘হত্যাচেষ্টার' অভিযোগে উত্তরা পূর্ব থানায় করা মামলায় অভিনেত্রী শমী কায়সারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন৷ শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সার ও লেখক, গবেষক, শিশু সংগঠক, সাবেক সংসদ সদস্য পান্না কায়সার দম্পতির সন্তান শমী কায়সার নব্বই দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী৷ একটি মামলায় তাকে হাইকোর্ট জামিন দিলেও পরে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন স্থগিত করেছে আপিল বিভাগ৷ ফলে সহসাই তার মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কম৷
আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শমী কায়সারকে কারাগারে একটি সাধারণ সেলে অন্য বন্দিদের সঙ্গে রাখা হয়েছে৷ সেখানে নানা ধরনের অপরাধে যুক্ত অপরাধীরাও আছে৷ কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না৷ শুধু এই দুইজন নয়, অন্তত ৬০ জন বন্দি গত দুই তিন মাসে গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাদের ডিভিশন পাওয়ার কথা আইন অনুযায়ী৷ অথচ কাউকেই এসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না৷
বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গিয়ে ‘জয় বাংলা' স্লোগান দিয়ে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমানকে গত ৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জ শহরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যুবদল ও ছাত্রদলের তিন নেতা-কর্মী নিহতের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ৷ ওই মামলায় তিনি বর্তমানে কারাগারে বন্দি আছেন৷ আব্দুর রহমানের স্ত্রী আইনজীবী জেবুন্নেছা জেবা রহমান বলেন, ‘‘আমার স্বামীকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে৷ এ ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়ে জড়িতদের বিচার দাবি করছি৷ পাশাপাশি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার মুক্তি দাবি করছি৷ বয়স্ক মানুষ, নানা ধরনের রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত, ফলে তার সুচিকিৎসাও প্রয়োজন৷''
বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন দেশের আপামর সব শ্রেণির মানুষ' আমরা কি সবাইকে সম্মান দিতে পেরেছি, পারিনি৷ এখনও পারছি না৷ তাই বিজয়ের মাসে আমার চাওয়া, মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান দেওয়া হোক, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দেওয়া হোক৷ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান না দিলে আমরা কেউই নিজেদের সম্মানিত করতে পারবো না৷''
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে অন্তত ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা এই মুহূর্তে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি৷ বর্তমান সময়কে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক ধরনের বিরূপ পরিস্থিতি বলেই মনে করছেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা৷ নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘স্বাধীনতার পর আশির দশকের শুরুতে যখন এরশাদ দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো৷ এরশাদ বেছে বেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সেনাবাহিনী থেকে অবসরে পাঠিয়েছেন৷ অনেকের বরাদ্দ পাওয়া রাষ্ট্রীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছিলেন৷ আর এত বছর পর ২০২৪ সালে এসে জীবনের শেষ প্রান্তে অসহায় বোধ করছি৷ নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি লুকিয়ে রাখতে এখন পছন্দ করছি৷'' কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এই অন্তর্বর্তী সরকার মুক্তিযুদ্ধটাকে যে ওন করছে, তার তো কোনো লক্ষণ দেখছি না৷ প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রথম দু'টি ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের কথা কিছুই বলেননি৷ যদিও পরের ভাষণগুলোতে বলেছেন৷ এখন কোনো সরকারি দপ্তরে গেলে, এমনকি হাসপাতালে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেই না৷''
বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল (অব.) আমিন উল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আজকে মুক্তিযোদ্ধাদের এই অবস্থার জন্য বিগত সরকারগুলোর নেওয়া পদক্ষেপই দায়ী৷ নানা সময় নানা ধরনের তালিকা করে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বিতর্কের মধ্যে ফেলা হয়েছে৷ আমি মনে করি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যদি সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা করেন, তাহলেই মুক্তিযোদ্ধাদের আর মুখ লুকিয়ে থাকতে হবে না৷ এই জন্য সরকারের প্রতি আমি একটি কমিশন গঠনের দাবি জানাই৷ সত্যিকারে যাদের অবদান ছিল, তাদের একটা তালিকা খুবই প্রয়োজন৷''
এবার কুচকাওয়াজ বন্ধ, সারা দেশে বিজয় মেলা
এবার বিজয় দিবসকে উৎসবমুখর করতে সারা দেশে বিজয় মেলার আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম৷ তিনি বলেন, ‘‘বিজয় দিবস আমাদের জাতির জন্য অনন্য দিন৷ ৯ মাস যুদ্ধ করে জাতি এই বিজয় অর্জন করেছে৷ সারা দেশের মানুষ যুদ্ধে সম্পৃক্ত ছিল৷ একসময় গ্রামে ও সারা দেশেই এই বিজয় উৎসব হতো৷ ধীরে ধীরে এই উৎসব নিষ্ক্রিয় ছিল৷ এবার সারাদেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিজয় মেলা হবে৷''
উপদেষ্টা বলেন, ‘‘আগে যে প্রচলিত কুচকাওয়াজ হতো, এতে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকতো না, সেখানে স্কাউট ও সেচ্ছাসেবকরা থাকতো৷ তার সঙ্গে অন্যান্য বাহিনী থাকতো৷ জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে এবার কুচকাওয়াজ হচ্ছে না৷ কারণ, সেনাবাহিনী এখন সারাদেশে ব্যস্ত৷ এটার জন্য একটা প্রস্তুতির বিষয় আছে৷ তাই এবার প্যারেড স্কয়ারে কুচকাওয়াজ হচ্ছে না৷ এটার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি প্রয়োজন৷ এই অনুষ্ঠানে সরাসরি জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল না৷ এবার শিশু, নারী, পুরুষ সব শ্রেণির জনগণকে সম্পৃক্ত করা হবে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় প্রোগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে৷ তেমনি ঢাকায় এখানকার জেলা প্রশাসন করবে৷ দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন৷ ১৪ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতি জাতীয় বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে যাবেন৷ সেখানে অনুষ্ঠান আছে৷ তারপর রায়ের বাজার যাবেন এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে৷''