বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সম্প্রীতি
৯ এপ্রিল ২০১৮এর আগে এমন মিছিল হয়েছে নন্দীগ্রামে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, কামদুনির গণধর্ষণের বিরুদ্ধে৷ কিন্তু এবারের মিছিলের ইস্যু ছিল আরও গুরুতর৷ বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক জমি দখল করতে চাইছে৷ সেই উদ্দেশ্যে তারা খুঁচিয়ে তুলছে হিন্দুত্ববাদী চিন্তা-ভাবনা৷ প্ররোচনা জোগাচ্ছে সুপ্ত মুসলিমবিদ্বেষে৷ পশ্চিমবঙ্গে আমদানি করা হচ্ছে গনেশ চতুর্থী, রামনবমীর মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বাঙালিদের মধ্যে যার কোনো চল ছিল না৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু কেবল বাঙালিদেরই বাস নয়, অনেক অবাঙালি হিন্দুও এই রাজ্যে বাস করে, তাদের থেকে খুব সহজে প্রশ্রয় পাচ্ছে হিন্দি বলয়ের ওই ধর্মীয় উন্মাদনা৷ রামনবমীর শোভাযাত্রার নামে অস্ত্র হাতে মিছিল হচ্ছে৷ এমনকি শিশুদেরও সেই অস্ত্র মিছিলে সামিল করা হচ্ছে৷
পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, সহাবস্থানে বিশ্বাসী, তাঁরা এই বদলাতে থাকা সংস্কৃতির গতি-প্রকৃতি দেখে প্রমাদ গুনছেন৷ কারণ এভাবে চলতে থাকলে পশ্চিমবঙ্গেও যে একদিন সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত শুরু হয়ে যাবে না, এমনটা আর কেউ জোর দিয়ে বলতে পারছে না৷ সামাজিক পরিবেশের এই বিষিয়ে যাওয়া রুখতে, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের অভিসন্ধিমূলক প্রসারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তাই গণ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছিল৷ এই মিছিলের আহ্বায়ক, বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব চন্দন সেন ডয়চে ভেলেকে জানালেন, এমন মিছিল শহর কলকাতা খুব কম দেখেছে৷ আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ততার কারণে জেলাগুলি থেকে অনেকেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আসতে পারেননি৷ তার পরেও প্রায় হাজার পঁচিশেক মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন৷ যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি এবং কলকাতা বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা, নাট্যকর্মী, শিল্পী, গায়ক, সাহিত্যিকরা অংশ নিয়েছিলেন৷ প্রমুখ নামের মধ্যে ছিলেন নাট্য ব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, বর্ষীয়ান চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার, নবীন পরিচালক অনীক দত্ত, চিত্রকর ওয়াসিম কাপুর৷ প্রবীণ অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেননি, কিন্তু তিনি একটি বার্তা পাঠান চন্দন সেনকে, যা পড়ে শোনানো হয়৷ সেই বার্তায় সৌমিত্র উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘‘শিশু-কিশোরদের হাতেও অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে! এই বীভৎসতা আগে দেখিনি৷''
তবে রবিবার, কলকাতার ধর্মতলা থেকে রবীন্দ্রসদন পর্যন্ত এই মিছিল যে কারণে আরও স্মরণীয় হয়ে রইল, তা প্রবীণ কবি শঙ্খ ঘোষের উপস্থিতির কারণে৷ অসুস্থ শঙ্খ ঘোষ আসতে পারবেন না, দূর থেকেই সমর্থন জানাবেন, এমনটাই জানা গিয়েছিল৷ কিন্তু প্রবল সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই, অশক্ত শরীরে চলে আসেন শঙ্খ ঘোষ এবং মিছিলের কিছুটা পথ হাঁটেনও৷ যদিও হাঁটতে পারছিলেন না, দু'দিক থেকে দু'জন ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁকে, কিন্তু সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই বাঙালি কবির ওই প্রতিবাদদৃপ্ত পদক্ষেপ একটা পর্যায়ে যেন প্রতীকী মাত্রা ধারণ করল৷ মিছিলে তখন স্লোগান উঠছে — বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত৷