‘বিশ্বের সাতটি টক শো’র একটি তৃতীয় মাত্রা’
২৩ অক্টোবর ২০১৮ডয়চে ভেলে: তৃতীয় মাত্রা কীভাবে শুরু হয়েছিল?
জিল্লুর রহমান: এটা শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে৷ তখন পার্লামেন্ট খুব একটা কার্যকর ছিল না৷ বিরোধী দল খুব একটা অ্যাকটিভও ছিল না৷ তাঁদের সংসদের প্রতি আগ্রহ ছিল কম৷ সেই সময় টেলিভিশনে টক শো বলতে যা বোঝায়, তাও ছিল না৷ যেগুলো ছিল সেগুলো একটা আলোচনা অনুষ্ঠানের মতো করে হতো৷ তখন আমি একটা পাইলট প্রজেক্টের মতো দুই-একটা টক শো করলাম৷ অপজিশন এবং সরকারি দল সবাইকে নিয়ে কয়েকটি করার পর আমার মনে হলো, এটা আমি করতে পারি৷ তখন সাগর ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলো৷ তিনি অনুমতি দিলেন যে এমন একটা অনুষ্ঠান করা যায়৷ এরপর মূল কাজ শুরু করলাম৷ আসলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি মাথায় রেখেই এবং সব পক্ষের মানুষ যেন এক টেবিলে বসতে পারেন সেই চিন্তা থেকেই এই অনুষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়৷
এমন একটি অনুষ্ঠানের চিন্তা কীভাবে আপনার মাথায় এসেছিল?
এটা কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশে আছে৷ এটা যে নতুন কনসেপ্ট তা না৷ বাংলাদেশে যেহেতু পলিটিক্যাল ডিবেটের কোনো প্ল্যাটফর্ম ছিল না, সে কারণে আমরা এই সুযোগটি নিয়েছি৷ এটা পার্লামেন্টে হলেই সবচেয়ে ভালো হতো কিন্তু সেখানে যেহেতু হচ্ছে না তাই সেই সুযোগটা আমরা নিয়েছি৷ একটা-দুটো অনুষ্ঠান করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে এটা করা সম্ভব৷ এবং সেটা পরবর্তীতে প্রমাণিতও হয়েছে৷ আসলে শুরুর দিন থেকেই দর্শকরা খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছে৷ আমি এমনও গেস্ট পেয়েছি যে তাঁরা কেউ ছয়বার, কেউ পাঁচবার, কেউ চারবার পার্লামেন্টে এসেছেন৷ অথচ তাঁদের মধ্যে দেখা হয়নি, কথা হয়নি৷ আমার এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁদের সামনাসামনি প্রথম দেখা হয় এবং কথা হয়৷ আসলে রাজনীতিটাকে একটা ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা আমরা করেছি৷ ইচ্ছা থাকলেই যে সেটা করা সম্ভব তা প্রমাণ করেছি৷
এই দীর্ঘ পথচলায় আপনার কি কোনো সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে?
আপনি নিজে যেহেতু গণমাধ্যমে কাজ করেন, আপনি নিজেও ভালো জানেন যে গণমাধ্যমকে সংকটের মোকাবিলা করেই পথ চলতে হয়৷ এই পথটা যে খুব একটা মসৃণ, সেটা কিন্তু না৷ এটা শুধু বাংলাদেশ না, উন্নত গণতন্ত্রের দেশেও এটা কিন্তু এতটা মসৃণ না৷ আমাদের মতো দেশে তো নিশ্চয় এটা ডিফিকাল্ট৷ আমি মনে করি এগুলো সাংবাদিকদের জীবনের অংশ৷ এগুলো মোকাবিলা করেই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে৷ যেমন ধরেন, কোনো অনুষ্ঠান আমাকে বন্ধ করে দিতে হয়েছে৷ আবার কোনো অনুষ্ঠান আমি প্রচার করতে পারিনি৷ চাপ তো সবসময়ই থাকে৷ তবে সব চাপ যে সরকারি, বিষয়টা তেমন না৷ যেমন ধরেন, বন্ধু-বান্ধবের চাপ থাকে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের চাপও থাকে, এমনকি আপনি যে টেলিভিশনে কাজ করছেন সেই টেলিভিশনেও চাপ থাকে৷ আবার পরিবার-স্বজনেরও চাপ থাকে৷
তৃতীয় মাত্রাকে কি আপনি অন্য টক শোগুলো থেকে আলাদা মনে করেন?
এই বিচারের ভারটা কিন্তু দর্শকদের৷ আর দর্শকরা আসলে এটার বিচার করেনও৷ দেখেন যতগুলো টক শো হয় তার মধ্যে প্রায় অর্ধেক ভিউয়ার্স কিন্তু তৃতীয় মাত্রার৷ টেলিভিশন টক শো নিয়ে কিন্তু অনেকগুলো সার্ভে হয়েছে৷ এমনকি সরকারিভাবে পিআইডি থেকেও হয়েছে৷ সেখানেও দেখা গেছে তৃতীয় মাত্রার অবস্থান অনেক উপরে৷ আমার মনে হয় এর একটা বড় কারণ যে, আমি প্রফেশনালি এটা করার চেষ্টা করি৷ এখানে আমি কোনো পলিটিক্যাল পার্টির কথা বলি না৷ আমার নিজের কোনো পলিটিক্যাল আইডিওলজি এখানে প্রচার করার চেষ্টা করি না৷ অন্তত কেউ আমাকে এই অভিযোগটা করতে পারবে না যে, আমি পলিটিক্যালি বায়াসড৷ তবে কেউ কেউ পলিটিক্যালি ব্লাইন্ড- এমন অভিযোগ করেন৷ তবে এটা আওয়ামী লীগের দিক দিয়ে যেমন আছে, তেমনি বিএনপির দিক দিয়েও আছে৷ যাঁরা একটু পলিটিক্যাল ব্লাইন্ড তাঁরা প্রশ্ন করলেই মনে করেন যে আমি অন্য দলকে ফেভার করার চেষ্টা করছি৷ এ ধরনের অভিযোগ সব রাজনৈতিক দল থেকেই আমার বিরুদ্ধে আছে৷ আমরা গেস্ট সিলেকশনের ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকার চেষ্টা করি৷ যদিও সবসময় সেটা করা সম্ভব হয় না৷ তারপরও আমরা সতর্ক থাকি৷
আপনি তৃতীয় মাত্রার কয়েকটি এপিসোডের কথা যদি বলেন যেগুলোতে স্মরণীয় কিছু ঘটেছে?
আসলে এটার এত এপিসোড, যে আমি আপনি যখন কথা বলছি তখন ৫ হাজার ৫৪৬তম পর্বটিও প্রচার হয়ে গেছে৷ আসলে এটা চলছে ১৬ বছর ধরে৷ এগুলো তো বলার অপেক্ষা রাখে না৷ তার মধ্যে আপনি যদি বলেন তাহলে আমি বলবো যে আমার প্রথম এপিসোডটি ছিল আমার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং৷ প্রথম এপিসোডে এসেছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এবং বার কাউন্সিলের সভাপতি ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ৷ ওইদিনই আসলে তৃতীয় মাত্রার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে৷ এর পরের পর্বটাতে এসেছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, যাঁর রাজনৈতিক পরিচয় আপনারা জানেন৷ তাঁকে আমি এমন কিছু প্রশ্ন করেছি, যেটা সাধারণত অন্য কেউ করার সাহস করবেন না৷ এই পর্বটি প্রচার হওয়ার পর অনেকেই আমাকে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন৷ তবে আমি খুবই কনফিডেন্ট ছিলাম৷
দীর্ঘ এই পথ চলায় তৃতীয় মাত্রার সঞ্চালক হিসেবে আপনার অর্জন কি?
আমি মনে করি আমার অর্জন মানুষের ভালোবাসা৷ আর বাংলাদেশের মতো একটি দেশে একটি অনুষ্ঠান প্রতিদিন করা এবং সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই অনুষ্ঠানটি খুবই সেনসিটিভ৷ এখানে পলিটিক্যাল বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়৷ যদিও আমরা অন্যান্য বিষয় নিয়েও অনুষ্ঠান করি৷ তারপরও এটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়াই বড় সাফল্য৷ এটার আরেকটা বড় সাফল্য হচ্ছে, বিশ্বের সাতটা লম্বা টক শোর মধ্যে এটা একটা৷ এটাকে আমি বড় অর্জন বলেই মনে করি৷
আপনি কি অন্য চ্যানেলগুলোর টক শো দেখেন?
দেখতে হয় আমাকে৷ আসলে আমি দেখি৷
সেগুলো কেমন হয়? কার উপস্থাপনা আপনার ভালো লাগে?
অনেকের টক শো-ই ভালো হয়৷ অনেকগুলো ভালো হচ্ছে৷ অনেকের উপস্থাপনাও আমার ভালো লাগে৷ অনেকে খুবই কঠিন প্রশ্ন করেন, অ্যাগ্রেসিভ৷ এটা আবার অনেকেই পছন্দ করেন না৷ অনেকের আবার বাচনভঙ্গি ভালো৷ অনেকে আবার প্রচুর হোমওয়ার্ক করে আসেন৷ এই সবগুলো গুণ অনেকের মধ্যেই আছে৷ একটা বিশেষ দুর্বলতা হলো পলিটিক্যাল বায়াসডনেস৷ এর ঊর্ধ্বে উঠে কেউ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে পারছেন, সেটা আমার কাছে মনে হচ্ছে না৷ এটা হতে পারে তাঁর নিজের দুর্বলতা, আবার হতে পারে তাঁর চ্যানেলের পলিসি, এটা ঠিক করে বলা মুশকিল৷ তবে এই বিষয়ে একটা বড় ঘাটতি আমাদের আছে৷ তবে অনেকেই পপুলার এটা তো নিঃসন্দেহে বলা যায়৷ যেমন খালেদ ভালো করেন, নবনীতা ভালো করেন, মিথিলাও ভালো করেন৷
শুরুর সঙ্গে যদি তুলনা করতে বলি তাহলে তৃতীয় মাত্রায় কি পরিবর্তন এসেছে?
আসলে টেলিভিশনের টক শোতে খুব একটা পরিবর্তন করার সুযোগ আছে এমনটি নয়৷ তবে আমরা গিমিক দেয়ার চেষ্টা করি৷ আমি হয়তো কাউকে স্কাইপে বা অন্য কোনোভাবে কানেক্ট করলাম বা আমি আউটডোরে গিয়ে শুটিং করলাম৷ এভাবে যতগুলো করা সম্ভব তৃতীয় মাত্রা কিন্তু সবগুলোই এক্সারসাইজ করেছে৷ কোন সমস্যা নেই৷ দিনশেষে এটা কিন্তু কথার অনুষ্ঠান৷ আপনি যদি ভালো গেস্ট দেন, ভালো কনটেন্ট দেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন, তাহলে কিন্তু মানুষ অনুষ্ঠান দেখে৷ এর বাইরে আপনি ১০ জনের সঙ্গে কথা বললেন, কানেক্ট করলেন, তাতে কিছু যায় আসে না৷ আমরাও কিন্তু ফোনো নিয়ে প্রোগ্রাম করেছি৷ কিন্তু দেখা যায় যে, মূল যাদের কথা শোনার জন্য মানুষ টেলিভিশন সেটের সামনে বসে আছে, তাদের আলোচনাটা শোনা হয় না৷ অনেকে আবার কন্ঠ শোনাবার জন্য প্রশ্ন করেন৷ অথচ সিরিয়াস দর্শকদের অনেকে আবার প্রশ্ন করেন না৷ আমরা সবগুলো ফরমেই এক্সারসাইজ করেছি৷ ভবিষ্যতেও হয়তো করবো৷ দিন শেষে আপনি দর্শকের জন্য কতটা ভালো কথাবার্তা দিতে পারছেন, সেটাই বিবেচ্য বিষয়৷
অনুষ্ঠানের অতিথি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আপনি কি স্বাধীন? না-কি কোনো চাপ থাকে?
আমি আসলেই কাজটা স্বাধীনভাবেই করছি৷ যদিও নানারকম চাপ থাকে৷ তারপরও এখানে আমার এক ধরনের স্বাধীনতা আছে৷ যতক্ষণ পর্যন্ত আমি মনে করবো যে আমি স্বাধীনভাবে কাজ করছি, ততদিন পর্যন্ত আমি তৃতীয় মাত্রার উপস্থাপনা করে যাব৷ আর যেদিন আমি দেখবো তৃতীয় মাত্রায় আমি স্বাধীনভাবে করতে পারছি না, তখন আমি নিজেই এখান থেকে সরে যাব৷
আপনি খুব কম কথা বলেন? এই কম কথা বলে এত লম্বা একটা অনুষ্ঠান কীভাবে চালান?
আসলে বাংলাদেশ না, আপনি যেখানেই থাকেন, যত কম কথা বলবেন বিপদ তত কম হবে৷ এটা আপনি পরিবারের মধ্যেও দেখবেন৷ যত বেশি কথা বলবেন তত বেশি বিপদে থাকবেন৷ যদিও এটা আমার বিবেচ্য বিষয় না৷ আসলে আমার কাজ তো কথা বলা নয়, কথা বলানো৷ অনেকে আমাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও করেন৷ আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটা আছে, আমি কথা কম বলি, ডানে-বামে তাকাই৷ মাঝে মধ্যে হাসি দেই৷ তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই করে যদি ১৬ বছর পার করা যায়, এই মূকাভিনয় করে যদি একটা অনুষ্ঠান ১৬ বছর চলে এবং সেটা যদি মানুষ দেখে, তাহলে অসুবিধা নেই৷ আর রিয়েলিটি হচ্ছে- আমি যেখানে কথা বলা দরকার সেখানে বলি৷ আমি আসলে আমার গেস্টকে কমফোর্ট দেয়ার চেষ্টা করি৷ আমি তাঁকে কমফোর্ট দিয়েই তাঁর কাছ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করি৷ আমি আমার গেস্টদের গেস্ট হিসেবেই দেখি৷ আমি তাঁদের এখানে এনে অপদস্ত করতে চাই না৷ এই প্রবণতাও আমি আমাদের কারও কারও মধ্যে দেখি৷ সেটা আমি করি না৷ সে কারণে আমার গেস্ট আমার অনুষ্ঠানে আসতে খুবই কমফোর্ট ফিল করেন, কথা বলতে চান৷ কথা বলে দর্শকের যেটা চাওয়া সেটা পূরণ করেন৷ তার মানে এই নয় যে, আমি তাদের কোথাও ছাড় দেই, তা কিন্তু না৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷