1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বৈষম্যবিরোধী সরকারের বৈষম্য কোন পথে?

১৫ নভেম্বর ২০২৪

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিলো বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গঠন৷ সবাইকে নিয়ে এমন একটি রাষ্ট্র গঠন যেখানে থাকবে ন্যায়বিচার, বাকস্বাধীনতা ও ভিন্ন মত চর্চার সুযোগ৷ সেই চেতনা বাস্তবায়ন কতদূর?

https://p.dw.com/p/4n2kA
শপথ নিচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP

বাংলাদেশে এখন আলোচিত শব্দ ‘ফ্যাসিবাদ'৷ আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকদের ‘ফ্যাসিবাদী' বলা হচ্ছে৷ এরইমধ্যে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছে৷

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ স্পষ্ট করেই ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক দলের কাতারে পড়ে না৷ আওয়ামী লীগ একটি সন্ত্রাসী সংগঠন, ফ্যাসিস্ট দল৷ দেশের মানুষই ৫ আগস্ট তাদের নিষিদ্ধ করে দিয়েছে৷ তাদের নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে৷ আর তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও লুকিয়ে আছে৷''

১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসে গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে নূর হোসেন চত্বরে আওয়ামী লীগকে কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হয়নি৷ আওয়ামী লীগ সন্দেহে অর্ধ শত ব্যক্তিকে মারপিট করে পুলিশে তুলে দেয়া হয়৷ এর আগে ঢাকায় জাতীয় পার্টিকেও সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি৷ কাকরাইলে তাদের পার্টি অফিসে হামলা ও আগুন দেয়া হয়েছে৷ জাতীয় পার্টিকে বলা হয়েছে ফ্যাসিবাদের দোসর৷

বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা স্পষ্ট করেই বলছেন মুজিবাদ, ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের সহযোগীদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না৷ তাদের কথা, সাংবাদিকদের মধ্যে আছে ফ্যাসিবাদের সহযোগী৷ আর সেই কারণেই তথ্য মন্ত্রণালয় এরইমধ্যে তিন দফায় মোট ১৬২ সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে৷

অন্যদিকে ৫ আগস্টের পর মব জাস্টিসের নামে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন অনেকে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, চলতি বছরের আগস্ট থেকে অক্টোবর এই তিন মাসেই নিহত হয়েছেন ৬৮ জন৷

‘ঢালাওভাবে প্রেস কার্ড বাতিল গ্রহণযোগ্য নয়'

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. জাহেদ উর রহমান বলছেন, ‘‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার আগ পর্যন্ত তাদের সভা করতে দেব না, সমাবেশ করতে দেব না, এটা হতে পারে না৷ আমার কাছে অবাক লাগে এই কথা সরকারের দিক থেকেও বলা হয়েছে৷ প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিবও বলেছেন৷ একটা রাষ্ট্র তো আসলে এভাবে চলবে না৷ রাষ্ট্র চলবে আইন কানুনের মধ্য দিয়ে৷ তাদের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিলেও সেটা আইনত দিতে হবে৷''

‘ঢালাওভাবে প্রেস কার্ড বাতিল গ্রহণযোগ্য নয়’

তার কথা, ‘‘১০ নভেম্বরের কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের কোনো খারাপ উদ্দেশ্যও থাকতে পরে৷ সেটা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দেখবে৷ কয়েকজনকে পিটানো হয়েছে৷ যাদের পিটানো হয়েছে তাদের খারাপ উদ্দেশ্য থাকলে পুলিশে দিন৷ কিন্তু যারা পিটিয়েছে তাদেরও পুলিশে দিতে হবে৷ মব জাস্টিস তো চলতে পারেনা৷''

‘‘এই পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক না৷ এবং যে বৈষম্যবিরোধী কথা বলা হচ্ছে তাও না৷ কোনো কিছু বেআইনিভাবে প্রয়োগ করে বৈষম্য দূর হয় না,'' বলেন তিনি৷

ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘‘কিছু সাংবাদিক আছেন যারা বিগত সরকারের স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় সহায়তা করেছেন৷ তাদের আমি সাংবাদিকই মনে করি না৷ কিন্তু ঢালাওভাবে যে প্রেস কার্ড বাতিল করা হচ্ছে, এটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়৷''

‘মাহফুজ আলমের বিচার হওয়া উচিত'

অন্যদিকে উপদেষ্টা পরিষদে সর্বশেষ যে তিনজন নতুন উপদেষ্টা শপথ নিয়েছেন তাদের মধ্যে শিল্পগোষ্ঠী আকিজ-বশির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেখ বশির উদ্দিন এবং চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে নিয়ে এখন চরম বিতর্ক চলছে৷ বসির উদ্দিনকে বাণিজ্য এবং মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে৷ বসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ তার এক ভাই আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন৷ আর মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সমর্থন দিলেও তিনি আগে ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর' ছিলেন৷ আর তার স্ত্রী তিশা একটি সিনেমায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের চরিত্রে অভিনয় করেছেন৷ এই দুইজনের সঙ্গে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের অনকে মন্ত্রীর ছবিও আছে৷

সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, ‘‘ফ্যাসিবাদের দোসর বলে চিহ্নিত করে এখানে একটার পর একটা যে ঘটনা ঘটছে আমি এটাকে গণতন্ত্র বলতে পারি না৷''

‘‘আওয়ামী লীগ সরকার শেষ সময়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে৷ কিন্তু তার আগে থেকেই তারা জামায়াতকে মিছিল-মিটিং করতে দেয়নি৷ বলতো তারা স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি৷ এখনো কিন্তু সেই একই ন্যারেটিভ চলছে৷ আমি মনে করি এটা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য কোনো ইতিবাচক নমুনা নয়৷ আপনি যদি মনে করেন তারা ফ্যাসিবাদের দোসর, সেটা তো মামলা করে প্রমাণ করতে হবে৷ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মামলা করে সেটা প্রমাণ করেন৷ তারপরে আদালতের নির্দেশে তাদের কাজ নিষিদ্ধ করেন৷ তার আগে তো পারেন না,'' বলেন তিনি৷

মাহফুজ আলমের বিচার হওয়া উচিত: মাসুদ কামাল

তার কথা, ‘‘বাংলাদেশের মিডিয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় তারা গণহারে প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করছে৷ এটা সাংবাদিকদের একটা সরকারি স্বীকৃতি৷ পেশাদার সকল সাংবাদিকের এটা পাওয়ার অধিকার আছে৷ আগের সরকার সবাইকে দেয় নাই৷ অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বিবেচনায় দিয়েছে৷ এখন আপনারা সেটা আরো কমিয়ে দিয়েছেন৷ সারজিস আলম তো আগের সরকারের সময় বঙ্গবন্ধুর স্তুতি গেয়ে আড়াই মিনিটের একটি ভিডিও পোস্ট দিয়েছিলো৷ তাহলে সেও কি ফ্যাসিবাদের দোসর?''

মাসুদ কামাল আরো বলেন, ‘‘একজন উপদেষ্টা সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়ে বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেললেন৷ এটা তো তার শপথ ভঙ্গ৷ তিনি তো সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে তা ভঙ্গ করলেন৷ কার ছবি থাকবে তা সংবিধানে থাকার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না৷ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ছবি থাকার কথা তো সংবিধানে এখনো আছে৷ তা তো বাতিল করা হয়নি৷ আপনি এই সংবিধানের অধীনে শপথ নিলেন কেন? আমি তো মনে করি মাহফুজ আলমের বিচার হওয়া উচিত৷''

‘ডেমোক্রেটিক প্রিন্সিপাল মেনে এগুলো হচ্ছে না'

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি চায় না৷ এই ধরনের রাজনীতি তারা নিষিদ্ধ চায়৷ তারা চায় ছাত্র সংগঠন ছাত্রদের দাবিদাওয়া নিয়ে ছাত্র রাজনীতি করবে৷ ক্যাম্পাসগুলোতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সক্রিয়৷ তারা সারাদেশে কমিটিও করছে৷ জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরও সক্রিয় আছে৷ কিন্তু বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলসহ অন্যান্য দলের ছাত্র সংগঠন কাজ করতে পারছে না৷ ছাত্রদলকে ধাওয়াও দেয়া হয়েছে৷

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ওরা তো এখান থেকে একটা রাজনৈতিক দল করার চিন্তা করছে৷ ডেমোক্রেটিক প্রিন্সিপাল মেনে এগুলো হচ্ছে না৷ তারা তো কয়েক ধরনের সংগঠন করছে৷ হয়তো সবমিলিয়ে একটা দল করবে৷ তারা মনে করছে দেশে একটা বিপ্লব হয়েছে৷ তাই তারা সব কিছু তাদের মতো করে করবে৷ এখানে অস্পটতা আছে৷''

আর বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘‘তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তো আরো অনেক বড় পলিটিক্যাল কথা বলছে৷ তারা সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলছে৷ সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলছে৷ তাহলে তারা রাজনীতি করতে পারলে অন্যরা কেন পারবে না৷''

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নিয়েছেন আরো তিন জন৷
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেয়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসাবে কাজ করে আসা মাহফুজ আলমের বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে৷ছবি: PID

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘‘আমার মনে হয় সরকার কনফিউজড যে তারা ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রের উত্তরণ কীভাবে ঘটাবে, পদ্ধতি বা পন্থা কী হবে৷ তারা বল প্রয়োগে করবে, না পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে করবে৷ তারা যখন দেখছে আওয়ামী লীগ তো বিভিন্নভাবে আছে, তারা মাঠে নামছে৷ তখন তারা মনে করছে এগুলো এখন দমন না করা হলে পরে আর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না৷ তাদের তো এই অষ্পটতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে৷''

ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘‘আমাদের একটা কথা মনে রাখা দরকার৷ এই সরকারেরও মনে রাখা দরকার৷ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে যে অভিযোগ ছিলো, এই সরকারের বিরুদ্ধেও যদি সেই অভিযোগগুলো করা যায় তাহলে সেটা হবে খুবই হতাশার৷''

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক বলেন, ‘‘ফ্যাসিস্ট রেজিমের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তারা যাতে আর ফিরে আসতে না পারে তার একটা চেষ্টা আছে৷ এর সঙ্গে চেতনাও আছে, আবেগ আছে৷ কিছুটা বাস্তবতাও আছে৷ এটা করতে গিয়ে একটা বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সব গণতান্ত্রিক দলের অংশগ্রহণে যে সমাজের কথা বলা হচ্ছে সেটা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে৷''

‘‘আমরা কোনো দল নিষিদ্ধের বিপক্ষে৷ কারণ তাতে ওই দলের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হয়৷ তাদের অপরাধ আড়াল হয়ে যায়৷ আওয়ামী লীগের যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ সুনির্দিষ্ট মামলা আছে তাদেরকে বাদ দিয়ে বাকি যারা আছেন তারা কীভাবে অনুশোচনা করবে, মাফ চাইবে তার ওপর নির্ভর করছে দল হিসাবে তারা কতটা ফিরতে পারবে,'' বলেন তিনি৷

‘আওয়ামী লীগ ছাড়া সবাই স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারছে'

তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ মনে করেন, ‘‘এখানে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও তাদের সহযোগী ফ্যাসিস্ট যারা আছে, ভিন্ন মত বলতে যদি তাদের কথা বলেন, তাদের সে সুযোগ নেই৷ তাদের মত যে ভিন্ন মত, সেই চিন্তার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করি৷ কিন্তু এখানে বিএনপি আছে, জামায়াত আছে, আরো অনেক দল আছে, বামপন্থি দল আছে৷ তারা ঠিক মতো মত প্রকাশ করতে পারছে কিনা৷ এখানে আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা ছাড়া আর সবাই স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারছে৷''

‘‘আওয়ামী লীগের আমলে যারা নিয়মিত শেখ হাসিনা সরকারের চাটুকারিতা করতে পারত তাদেরই সচিবালয়ের এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কার্ড দেয়া হতো৷ তাই সেইসব কার্ড বাতিল করে যারা ফ্যাসিস্টের সময়ে নির্যাতিত হয়েছে সেই সাংবাকিদকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেয়া হবে৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান