ব্যবসার জন্য বাংলাদেশ প্রিয় যে জার্মানি প্রবাসীর
২৭ জুলাই ২০২০বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রেসাদ রাকিব৷ প্রাকৃতিক নৈসর্গের জন্য বিখ্যাত জার্মানির আইফেল অঞ্চলের এই বাসিন্দা জার্মানিতে পাড়ি জমান ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে৷ এরপর নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ইউরোপের দেশটিতে সফল ক্যাবল বা তার ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন রাকিব৷ স্পেশাল ক্যাবল জিএমবিএইচ-এর মালিক রেসাদ রাকিব বলেন, ‘‘ক্যাবল বা তার সম্পর্কে আমি জানি৷ ফলে এই ব্যবসা করতে গিয়ে আমি যদি কোথাও ভুল করি, তাহলে তা বুঝতে পারবো৷ আর অন্য কোনো কিছুর ব্যবসা করলে, অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হতো৷ আর তখন ভুল করলে বুঝতে পারতাম না৷''
নিজেকে প্রস্তুত করেছেন যেভাবে
বাংলাদেশে থাকতেই পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসা করতেন রেসাদ রাকিব৷ ঢাকার নবাবগঞ্জে কেটেছে তার ছোটবেলা৷ কয়েকটি লঞ্চ ছিল তার পরিবারের৷ সেগুলো দেখাশোনার পাশাপাশি ক্যাবল ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হন তিনি৷ জার্মানিতে আসার পর শুরুতে বার্লিনে জার্মান ভাষা শিখেছেন এবং পরবর্তীতে সেখানকার টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ক্যাবল সিস্টেম বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন৷
তবে জার্মানিতে পড়াশোনা শেষ করার পরপরই ব্যবসা শুরু করা সম্ভব হয়নি৷ বরং ক্যাবল উৎপাদনকারী জার্মান প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন চাকুরি করেছেন তিনি৷ ক্যাবল বা তার পরীক্ষার কাজটি বেশ ভালো পারেন রেসাদ রাকিব৷ ফলে কর্মী হিসেবে তার ছিল বাড়তি কদর৷ ইউরোপে ক্যাবল ব্যবসায়ী হিসেবে তার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৭ সালে৷ রাকিব বলেন, ‘‘১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে এখানে ব্যবসা শুরু করি৷ তখন এটা ছিল ব্রোকারি (দালালি) ব্যবসা৷ অর্থাৎ, আমি ইটালি থেকে পণ্য কিনে এনে এখানে বিক্রি করতাম৷''
তবে ইটালি থেকে পণ্য কিনে এনে জার্মানিতে বিক্রি করার এই ব্যবসা নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না রাকিব৷ তার কাছে এটাকে ব্যবসার চেয়ে ‘ব্রোকারি' মনে হতো বেশি৷ তাই আইফেলের সিমারাথে নিজের বাড়ির নীচ তলায় এই গোডাউনের পাশাপাশি এক পর্যায়ে আখেন শহরে গড়ে তোলেন ক্যাবল তৈরির নিজস্ব কারখানা৷ বাড়ি থেকে গাড়িতে বিশ মিনিট লাগে সেই কারাখানায় পৌঁছাতে৷
খদ্দেরের সঙ্গে ‘বিশ্বাস স্থাপন' জরুরি
জার্মানিতে ব্যবসা করতে গিয়ে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে এই বাংলাদেশি জার্মান ব্যবসায়ীর৷ তিনি মনে করেন, খদ্দেরের সঙ্গে বিশ্বাস স্থাপন এবং সেটা ধরে রাখাটা ব্যবসায়ীদের জন্য সবচেয়ে জরুরি আর ইউরোপে ব্যবসার মূল ভিত্তিও এটি৷
রেসাদ রাকিব বলেন, ‘‘ধরেন, এখন যে গাড়িটা চালাচ্ছি - মার্সিডিজ৷ এ ধরনের গাড়ি চালালে অনেক কোম্পানি বলে যে, না, তোমার কাছে অনেক পয়সা আছে৷ তোমাকে এই অর্ডার দেবো না৷ আমাকে তখন আসলেই অর্ডার দেয় না৷ আবার অনেক কোম্পানি আছে তারা বলে যে, তুমি স্যুট, টাই, মার্সিডিজ না নিয়ে এলে তোমাকে আমরা অর্ডার দেবো না৷ আমি যদি বলি কেন? তখন বলে যে, তোমার কাছে যদি এসব না থাকে, তার মানে তোমার কাছে বেশি পয়সা নেই৷ তুমি অনেক সস্তা কাচামাল ব্যবহার করবে৷ সেজন্য তোমাকে অর্ডার দেবো না৷''
সাফল্যের পেছনে পরিবার
আখেনের ক্যাবল কারখানাতে উৎপাদন শুরু হয় ২০০৫ সাল থেকে৷ বিশ্বে যতরকমের তার সাধারণত ব্যবহার করা হয়, তার প্রায় সবগুলোই এখানে উৎপাদন সম্ভব৷ রাশেদ রাকিব নিজে খদ্দেরের চাহিদা অনুযায়ী তারের নকশা তৈরি করেন৷
আর আখেন শহর জার্মানির এমন এক অঞ্চলে অবস্থিত যেখান থেকে বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, লুক্সেমবুর্গের মতো দেশগুলোতে সহজেই পণ্য পাঠানো যায়৷ এ কারণে এই শহরকেই ব্যবসার জন্য বেছে নিয়েছেন তিনি৷
রাকিবের কারখানায় স্বয়ংক্রিয় মেশিনও ব্যবহার করা হয়৷ তবে, প্রতিটিক্ষেত্রেই সতর্ক নজর রাখেন তিনি৷ জার্মানি প্রবাসী এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘আমাদের এখানে ২৩ জন লোক কাজ করে, তিন শিফটে৷ আমরা এখানে সব ধরনের কম্পাউন্ডই তৈরি করি৷ ইউরোপের প্রায় সব দেশে রপ্তানির পাশাপাশি এশিয়ায় মালয়েশিয়াতেও আমরা আমাদের পণ্য রপ্তানি করি৷ জার্মানিতে এরকম আরো কোম্পানি আছে৷ কিন্তু আমি মনে করি, আমরা ফ্লেক্সিবল বেশি৷ আর খুব দ্রুত সবকিছু করতে পারি৷ সেজন্য এই করোনার সময়েও আমাদের কাছে যথেষ্ট অর্ডার আছে৷ অনেক জার্মান কোম্পানি এখন বন্ধ আছে৷ কিন্তু আমাদেরটা চলছে৷''
ক্যাবল বা তার ব্যবসায় নিজের এই সাফল্যের পেছনে পরিবারের অবদানকেই বড় করে দেখেন রেসাদ রাকিব৷ ব্যবসা শুরুর পুঁজি তিনি পারিবারিক সঞ্চয় থেকে পেয়েছেন৷ তাঁর স্ত্রী ডা. তসলিমা রাকিব জার্মানিতে সুপরিচিত একজন চিকিৎসক৷ রাকিব বলেন, ‘‘আমার স্ত্রী সবসময় আমার পাশে ছিল এবং আছে৷ আমি আগে অনেক পণ্য কিনতাম ইটালি থেকে৷ তখন সে আমার সঙ্গে ইটালি গেছে৷ মাঝরাতে গাড়ি চালিয়ে সেখানে গিয়েছি, আবার পরের দিন রাতে ফেরত এসেছি৷''
বিদেশিদের উপর ভরসা, তবে ভালো বাংলাদেশ
রেসাদ রাকিবের কারখানাতে বাংলাদেশি বলতে শুধু তিনি এবং তার ছেলে রাসুল রাকিব৷ শুরুতে কয়েকজন বাংলাদেশি কর্মী কাজ করেছেন তার কারখানাতে৷ তবে তাদের কর্মদক্ষতায় সন্তুষ্ট না হওয়ায় এখন শুধু ইউরোপীয়দের উপরই ভরসা করছেন তিনি৷
ব্যবসার জন্য অবশ্য জার্মানির চেয়ে বাংলাদেশকে সুবিধাজনক মনে করেন রাকিব৷
তিনি বলেন, ‘‘ম্যাটেরিয়ালের কথা চিন্তা করলে জার্মানিতে সবকিছুই আছে, সবকিছুই সহজে পাওয়া যায়৷ যেভাবে চান, সেভাবেই পাবেন৷ অন্যদিকে, বাংলাদেশে সেটা পাওয়া একটু কষ্টকর, কারণ, অনেক কিছু আমদানি করতে হয়৷ তবে ব্যবসার লাইনটা বাংলাদেশে জার্মানির চেয়ে সহজ৷ এই দেশে নিয়ম-কানুন অনেক কড়াভাবে পালন করতে হয়৷ বাংলাদেশেও করতে হয়, তবে সেটা এদেশের মতো এতে কড়া বা কঠিন নয়৷''
ক্যাবল ব্যবসা থেকে বছরে সাড়ে চার মিলিয়ন ইউরো আয় করেন রেসাদ রাকিব৷ এর মধ্যে ৪২ শতাংশ লাভ তার৷