হিট লিস্টের খবর ‘ভুল’
২৪ নভেম্বর ২০১৭বাংলাদেশে ব্লগার হত্যা থেমেছে, কিন্তু শেষ হয়নি৷ এখনও সক্রিয় ‘খতম তালিকা' ধরে মৌলবাদী জঙ্গিদের গোপন প্রস্তুতি৷ এই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেল সম্প্রতি কলকাতা পুলিশের বিশেষ নাশকতা দমন বাহিনী ‘স্পেশাল টাস্ক ফোর্স', বা এসটিএফ-এর হাতে ধৃত দুই বাংলাদেশি জঙ্গিকে জেরা করে৷ বাংলাদেশে আল কায়দার সহযোগী গোষ্ঠী আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের ওই দুই সদস্য শামসাদ মিঞা, ওরফে তানভীর এবং রিয়াজুল ইসলামের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ফারুক সাদিক নামে বাংলাদেশের এক ব্লগারের গতিবিধির বিস্তারিত তথ্য৷ তিনি কখন কোথায় থাকেন, কোথায় যান, সব খবর জোগাড় করেছে জঙ্গিরা৷ তাঁর যাতাযাত আছে, এমন সব জায়গায় বার বার রেকি-ও করা হয়েছে৷ ডয়চে ভেলেকে এই খবর দিলেন কলকাতা পুলিশের এসটিএফ বাহিনীর এক পদস্থ কর্তা৷
প্রসঙ্গত তিনি জানিয়েছেন, ব্লগারদের নতুন খতম তালিকা তৈরি করেছে বলে সংবাদ মাধ্যমের একাংশ যে খবর দিচ্ছে, তা ঠিক নয়৷ ব্লগার ফারুক সাদিক সম্পর্কে বিস্তারিত খবরাখবর জোগাড়ের ওই তথ্য ছাড়া অন্য কোনো ব্লগার সম্পর্কে কোনো তথ্য বা নতুন কোনও খতম তালিকার খবর কলকাতা পুলিশের কাছে নেই৷ তিনি আরো জানান, দুই জঙ্গি ধরা পড়ার পর সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে পুলিশের শুধু বছর তিনেক আগে বাংলাদেশি জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রকাশ করা হিট লিস্ট নিয়েই কথা হয়েছে এবং সেই তালিকা বাংলাদেশ পুলিশের হাতে আগে থেকেই আছে৷
ধৃত দুই জঙ্গি তানভীর এবং রিয়াজুলকে জেরা করে আরও জানা গেছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অন্তত ২৫ জন সক্রিয় সদস্য এখন তৎপর ভারতের বিভিন্ন অংশে, যাদের লক্ষ্য উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায়, অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দরাবাদে এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় আল কায়দার স্লিপার সেল গড়ে তোলা৷ গোপনে নাশকতার প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি জঙ্গি মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া, জঙ্গি গোষ্ঠীতে নতুন ছেলেদের শামিল করা, তাদের নাশকতার তালিম দেওয়ার মতো নানা কাজ করে সেই স্লিপার সেল৷ সম্প্রতি কলকাতা পুলিশের বিশেষ সন্ত্রাস দমন শাখা এসটিএফ-এর হাতে ধরা পড়া দুই জঙ্গি শামসাদ মিঞা ওরফে তানভীর এবং রিয়াজুল ইসলামকে জেরা করে এমন খবরই জেনেছে পুলিস৷ ব্যাপারটা কতখানি গুরুতর, সেটা বোঝা যাচ্ছে পুলিশের পরবর্তী তৎপরতায়৷ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ, হায়দরাবাদ পুলিশের এসটিএফ এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গোয়েন্দারা বৃহস্পতিবারই পৌঁছে গেছেন কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর লালবাজারে৷ ধৃত দুই জঙ্গিকে দফায় দফায় জেরা করা হচ্ছে৷
ধৃত শামসাদ মিঞা ওরফে তনভির আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের অন্যতম বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ৷ সেকথা সে কবুল করার পর পুলিশ তাকে দূর নিয়ন্ত্রিত বোমা তৈরির সরঞ্জাম দিয়ে বলেছিল, চটজলদি বিস্ফোরক কীভাবে তারা তৈরি করে, সেটা হাতে-কলমে করে দেখাতে৷ উচ্চ ক্ষমতার একটি বিস্ফোরক তানভীর তৈরি করেছে দু ঘণ্টার মধ্যে! তানভীর এবং রিয়াজুলের কাছে পাওয়া গেছে আল কায়দার মতাদর্শ বিবৃত করা প্রচার পুস্তিকা, যেগুলো সব বাংলায় লেখা৷ ওরা জানিয়েছে, বইগুলো ছাপানো হয়েছে বাংলাদেশে৷ এছাড়া পাওয়া গেছে একাধিক সিম কার্ড, যেগুলো তারা নিয়মিত বদলে বদলে ব্যবহার করতো৷ এবং পাওয়া গেছে ভারতীয় নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র ‘আধার কার্ড', যাতে পরিচয় এবং ঠিকানা ভুয়ো হলেও কার্ডে সংরক্ষিত হাতের আঙুলের ছাপ, চোখের মণির গঠন ইত্যাদি ‘বায়োমেট্রিক ডিটেল' ওদের নিজেদেরই! এরপরেই প্রশ্ন উঠে গেছে, মোদী সরকার যে আধার কার্ডকে ভুয়ো নাগরিকত্বের সমস্যার আদর্শ সমাধান হিসেবে প্রচার করে, তার যথার্থতা নিয়েই৷
বস্তুত জঙ্গিদের আধার কার্ডের খবর ফাঁস হওয়ার পরই একটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেল একটি স্টিং অপারেশন চালায়, যাতে দেখানো হয়েছে কত কম সময়ে এবং কী সহজে যে কারও আধার কার্ড বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে৷ তারপরেই নড়েচড়ে বসেছে এনআইএ এবং অন্যান্য সন্ত্রাস দমন সংস্থা৷ আর পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনের কাছেও বিষয়টা অত্যন্ত অস্বস্তিকর, যেহেতু তানভীর এবং রিয়াজুলকে জেরা করে পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে, এই রাজ্যে ওরা কার্যত বিনা বাধায় এতদিন ঘোরাফেরা করেছে৷ পুলিশের জেরায় ওরা জানিয়েছে, কলকাতা শহরে বা রাজ্যের অন্যত্র ওদের স্থায়ী কোনও থাকার জায়গা ছিল না৷ ওরা থাকত বাস স্ট্যান্ডে, রেল স্টেশনে, অথবা রাস্তার ধারে, যা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়৷ এমন হতেই পারে যে, বহিরাগত এই জঙ্গিদের স্থানীয় আশ্রয় এবং মদত পুরোমাত্রায় ছিল, যার হদিস পেতে এখন তৎপর গোয়েন্দারা৷